বাংলাদেশে নারী ও শিশু ধর্ষণ যেন পান্তা ভাতের মতন। নারীদের সুযোগে কাছে পেলেই সোজাসুজি ধর্ষণ করতে কাল বিলম্ব নয়! স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি, বাসা- বাড়িতে, চলন্ত বাস, দিবা-লোকে, পার্কে বসে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে নারী ও শিশু ধর্ষণের জগন্যতম ঘটনা। আবার ধর্ষক নামের নরপশুদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না নারী ও শিশুরা। পূর্বেকার সময়ও নারীরা ধর্ষিতা হত, তবে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যেত। কিন্তু যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যুবসমাজ ধর্ষণ শেষে নারীকে নির্মমভাবে হত্যা করার প্রচলন শুরু করেছে।
যুবকদের কি দয়া-মায়া বলতে কি কিছুই নেই? একজন নারীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করার পরে তাদের যে অসহনীয় ব্যথা কষ্ট তা কেবল নারী ভুক্তভোগীরা ভালো জানেন। ধর্ষণের পরে আবার গলা টিপে তাকে হত্যা করা কত অপরাধ ও গুনাহের কাজ তা ভেবে দেখলে ঘৃণিত পাপীষ্ঠ কাজ মানুষ আর কখনো করত না। শুধু নারী ধর্ষণ করে ক্ষান্ত নয়, বেছে নিয়েছে শিশু ধর্ষণও। যখন পেপার পত্রিকার পাতায় ভেসে ওঠে এসব চিত্র, তখন লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায়।
ইতোমধ্যে সরকার ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আইন পাস করেছেন।প্রশাসনের কড়া নজরদারী থাকলেও শিশু ও নারী ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না বরংস বেড়েই চলছে। রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পদে নারী নেতৃত্ব থাকার পরও নারী ধর্ষণ, নারী নির্যাতন কিভাবে হয় সেটা বোধগম্য। সরকার প্রধানের কাছে আকুল আবেদন থাকবে আপনি একজন নারী হিসেবে অন্ততপক্ষে নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনকে রোধ করার যুগন্তরি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে নারীরা তাদের সতীত্ব বজায় রেখে সংসার পরিচালনা করতে আর বাধা থাকবে না।
২০১৯ সালে ধর্ষণের শিকার ১৪১৩ নারী
২০১৯ সালে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৪১৩ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১০ জন। আইন ও সালিশ আয়োজিত ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৯ : আসকের পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১৭ সালে দেশে ৮১৮টি ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও ২০১৮ সালে তা কিছুটা কমে ৭৩২ এ নেমে আসে। কিন্তু চলতি বছর সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
২০১৯ সালে বেড়েছে উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানির ঘটনাও। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২০১৯ সালে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছেন মোট ২৫৮ নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানীর শিকার হন ৪৪ জন পুরুষ। এছাড়াও ২০১৯ সালে উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১৮ জন নারী। এ ছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন হয়েছেন ১৭ জন নারী ও পুরুষ। ২০১৮ সালের আসকের দেয়া তথ্য মতে, সে বছর যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন মোট ১৭০ জন। এছাড়াও সালিশের নামে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন চার (৪) জন নারী। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ১৬৭ নারী। যার মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা যান ৯৬ জন এবং আত্মহত্যা করেন তিন জন (সময় সংবাদ)।
ইসলামী শরীয়াতে ধর্ষণের শাস্তি:
ইসলামে ব্যভিচারের শাস্তি ব্যক্তিভেদে কিছুটা ভিন্ন হয়ে থাকে। ব্যভিচারী বা ধর্ষক যদি বিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। আর ধর্ষক যদি অবিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে একশ ডোররা মারা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ব্যভিচারিণী নারী- ব্যভিচারী পুরুষ, তাদের প্রত্যেককে একশ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর করার কারণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ইসলামে ধর্ষণের শাস্তি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।- সূরা নূর: ২
ইসলামে ব্যভিচার হারাম ও হত্যার পর বৃহত্তম অপরাধ। পবিত্র কোরআন মজিদের সুরা আল ইসরা’র ৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আল- আমীন বলেন, ‘আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ বিবাহবহির্ভত যেকোনো যৌন সঙ্গমই পবিত্র ইসলাম ধর্মে গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য। ইসলামি আইন শাস্ত্রে ধর্ষকের কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর যুগে এক মহিলাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) ধর্ষককে হদের (কোরআন-হাদিসে বহু অপরাধের ওপর শাস্তির কথা আছে। এগুলোর মধ্যে যেসব শাস্তির পরিমাণ ও পদ্ধতি কোরআন-হাদিসে সুনির্ধারিত তাকে হদ বলে) শাস্তি দেন।’ -ইবনে মাজাহ: ২৫৯৮
হযরত উমর (রা.) এর শাসনামলে সরকারি মালিকানাধীন এক গোলাম এক দাসির সঙ্গে জবরদস্তি করে ব্যভিচার (ধর্ষণ) করে। এতে ওই দাসির কুমারিত্ব নষ্ট হয়ে যায়। হযরত উমর (রা.) ওই গোলামকে কষাঘাত করেন এবং নির্বাসন দেন। কিন্তু দাসিটিকে কোনো শাস্তি প্রদান করেননি।’ -সহিহ বোখারি: ৬৯৪৯ হাদিসে বলা হয়েছে, অবিবাহিত পুরুষ- নারীর ক্ষেত্রে শাস্তি একশ বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর। আর বিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে একশ বেত্রাঘাত ও রজম অর্থাৎ পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড -সহিহ মুসলিম। ধর্ষণের ক্ষেত্রে একপক্ষে ব্যভিচার সংগঠিত হয়। আর অন্যপক্ষ হয় নির্যাতিত। তাই নির্যাতিতার কোনো শাস্তি নেই। কেবল অত্যাচারি ধর্ষকের শাস্তি হবে।
ধর্ষিতার করণীয়:
ইসলামী আইনবিদরা এ মর্মে ঐকমত্যে রয়েছেন যে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে ধর্ষণের কারণে অভিযুক্ত করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে তার কোনো পাপ নেই। কেননা ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার ওপর বল প্রয়োগ করা হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মতের ভুলবশত করা অপরাধ, ভুলে যাওয়া কাজ ও বল প্রয়োগকৃত বিষয় ক্ষমা করে দিয়েছেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২০৪৫)
ইসলামে ব্যভিচারের পাশাপাশি ধর্ষণও কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। কোনো ব্যক্তি যদি ধর্ষণের শিকার হয়, তাহলে তার সর্বপ্রথম করণীয় হলো, সম্ভব হলে তা প্রতিরোধ করা। এমনকি যদিও তা ধর্ষণকারীকে হত্যা করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে, তাতেও ইসলাম সায় দিয়েছে। সাঈদ ইবনে জায়েদ (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে, সে শহীদ। জীবন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সে-ও শহীদ। দ্বিন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সে শহীদ। আর সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সে-ও শহীদ।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৭২; তিরমিজি, হাদিস : ১৪২১)
লেখক, কলামিষ্ট, গণমাধ্যম, মানবাধিকার কর্মী ও সম্পাদক: দৈনিক ওলামা কন্ঠ