শিরোনাম

জিবন ইতিহাস (নস্টালজিয়া) মায়ার বাধন-১: মোস্তফা হারুন, সহকারী পুলিশ সুপার

একদিন আমাদের মুকুল ফৌজের এক অনুষ্ঠান ছিলো। মা বাবা কে না বলে দুই ভাইবোন মুকুল ফৌজের অনুষ্ঠানে মান্ডা এলাকায় যাই। বিকালের দিকে গিয়ে মজা পেয়ে বাড়ী ফেরার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম!

আমার জন্ম বগুড়া জেলার শাজাহানপুর উপজেলার চৌপিনগর গ্রামে। নানার বাড়ীতে হলেও জীবন শুরু হয় বাবার কাজের জায়গা ঢাকাতেই। তখন আমি আর আমার বড় বোন শিমু ছাড়া কেউ ছিলনা। আমরা মুসলিম হাইস্কুলে লিখা পড়া শুরু করি। দুই ভাইবোনের ভিষণ মিল, যেখানে যেতাম একসাথে যেতেম, একসাথে খেতাম, একসাথে খেলতাম।

মোস্তফা হারুন- সিনিয়ার সহকারী পুলিশ সুপার, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।

আমরা মুগদাপাড়ায় একটি ভাড়া করা বাসায় থাকতাম। বাবার অফিস ছিল মতিঝিল রুপালী ব্যাংকের হেড অফিসে। আমরা দুই- ভাইবোন ছাত্র জীবনে মুকুল ফৌজ করতাম। বাবা অফিস থেকে ফিরে এসে আমাদের দুজন-কে নিয়ে পড়াতে বসতেন। আমি ক্লাস টু এবং বোন ক্লাস থ্রিতে পড়তো।

বাবা খুব রাগী টাইপের মানুষ ছিলেন। যখন পড়াতে বসতেন বাবার হাতে থাকতো একটি লাঠি। কখনো লাঠি না পেলে পায়ের সেন্ডেল ব্যাবহার হতো আমাদের উপর। বাবা পড়াতে বসলেই জানা জিনিস ভুলে যেতাম। বাবা নাছোরবান্দা পড়া আদায় না করা প্রর্যন্ত খাবার দিতেন না। জমের মত ভয় করতাম। মা ছিলেন আমাদের রক্ষাকারী শক্তি।

যখন পড়া না পারার কারণে বাবা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে তেড়ে আসতেন। মা দৌড়ে এসে আমাদের প্রটেকশন দিতেন। মাও মাঝে মধ্যে বাবাকে ভিষণ ভয় করতেন। কত যে লাঠির আঘাত ও সেন্ডেল দিয়ে মার খেয়েছি তার কোন হিসাব নেই।

একদিন আমাদের মুকুল ফৌজের এক অনুষ্ঠান ছিলো। মা বাবা কে না বলে দুই ভাইবোন মুকুল ফৌজের অনুষ্ঠানে মান্ডা এলাকায় যাই। বিকালের দিকে গিয়ে মজা পেয়ে বাড়ী ফেরার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। রাত ৯ টা বেজে চলেছে, বাড়ী যাবার কোন তাড়া নেই। মুকুল ফৌজের লিডার আমাদেরকে আস্বস্ত করেছিলেন প্রত্যেককে বাড়ী পৌঁছে দিবেন। এদিকে অধিক রাত হওয়ার কারণে বাবা মা ভিষণ চিন্তায় পড়ে গেছেন।

তারা হন্নে হয়ে খোজ করতে করতে হয়রান হয়ে গেছে। এত ছোট দুটি ছেলেমেয়ে কোথায় গেলো? অবশেষে বাবা তার এক বন্ধুর কাছে জানতে পারলেন, আমাদেরকে মুকুল ফৌজদের গ্রুপের সাথে র‍্যালি করে যেতে দেখেছেন। বাবা খোজ নিয়ে জানতে পারলেন আমরা মান্ডায় অনুষ্ঠানে আছি। বাবা খোজ করার জন্য রাতেই মান্ডায় চলে গেলেন।

আমাদের লীডারের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলেন এবং লীডার বাবাকে আমাদের কাছে নিয়ে এলেন। বাবাকে দেখে আমরা উচ্ছাসিত। মনে করলাম বাবা আমাদের অনুষ্ঠান দেখতে এসেছেন। বাবা আমাদের বললেন চলো অনেক রাত হয়েছে বাড়ী যেতে হবে। আমরা বললাম বাবা এখানে রাতের খাবার আয়োজন আছে। আপনিও থাকেন একসাথে খেয়ে তারপরে যাবো।

বাবা উত্তরে বললেন, আরে তোমাদের জন্য অফিস থেকে আসার সময় অনেক ভাল ভাল খাবার নিয়ে এসেছি। এখানে খেলে ওসব খাবে কে। খাবারের লোভ সামলাতে পারলামনা। আমরা দুজন লীডারে অনুমতি নিয়ে বাবার হাত ধরে বাড়ীর পথে হাটা শুরু করলাম। পথে যেতে যেতে বাবাকে বহুবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমাদের জন্য কি খাবার এনেছেন। উত্তরে বাবা বলেছিলেন চলো বাড়ী গেলেই দেখতে পাবে। যাইহোক অপেক্ষার পালা শেষ হলো।

বাসায় পৌঁছে মার কাছে দৌড়ে গেলাম। আমাদের খাবার কৈ? ইতিমধ্যে বাবা পায়ের জুতা খুলে আমাদের দুজনকেই বেদম পেটাতে পেটাতে বলছেন এটাই তোমাদের উত্তম খাবার। আমরা তো কান্নায় অস্থির। কিছুক্ষণ পর মা এসে আমাদের রক্ষা করতে গিয়ে তিনিও জুতার কয়েক ঘা খাবার খেলেন। শেষ প্রর্যন্ত মা আমাদেরকে রক্ষা করলেন। আদর করে আমাদের বুঝালেন, কান্না থামার পর খেতে দিলেন।

মা আমাদের তারাতাড়ি ঘুমাতে বললেন এবং সতর্ক করলেন, জেগে থাকলে তোমাদের বাবা আবার রেগে যেতে পারেন। বাবা সেই রাতে রাগে ক্ষোভে রাতের খাবার খেলেন না। মাকে বোকাঝোকা করলেন, তোমার কারনেই ওরা একাকী কাউকে না বলে যাওয়ার সাহস পেয়েছে। মাও ভয়ে কোন জবাব দিলেন না। বাবা খায়নি বলে মাও না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। এরপর থেকে আমি বাবার বিনা অনুমতিতে কোথাও যেতাম না। পিতামাতার শাসন ব্যাবস্থা ছিলো খুব কঠিন। (চলবে)

লেখক: মো: মোস্তফা হারুন বন্দ্রেরী, সিনিয়ার সহ- কারী পুলিশ সুপার, ২ এপিবিএন, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।

নিউজটি শেয়ার করুন :