শিরোনাম

পহেলা বৈশাখ: শেখ একেএম জাকারিয়া

 

পহেলা বৈশাখ বাঙালির বা বাংলাদেশিদের হাজার বছরের ঐতিহ্য কীভাবে হয় সেটাই ভাবছি। বইপত্রাদি ঘেঁটে কোথাও পাইনি এটি হাজার বছরের ঐতিহ্য। অথচ দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও শিক্ষিত সমাজ বলে বেড়ান, পহেলা বৈশাখ বাঙালির বা বাংলাদেশিদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। আমার ফেইসবুক বন্ধুতালিকায় অনেকেই আছেন যারা ঢাকঢোল পিটিয়ে চৈতের মাঝামাঝি সময় থেকে আজ অবধি একটার পর একটা স্ট্যটাস ( প্রবন্ধে, পদ্যে, কবিতা ও ছড়ায় ) দিয়েই যাচ্ছেন পহেলা বৈশাখ ও বাংলা সন বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই যে কবি,সাহিত্যিক, ছড়াকার ও গবেষকগণ পহেলা বৈশাখ কিংবা বাংলা নববর্ষ নিয়ে শতরকম পদ্য, কবিতা, প্রবন্ধ কিংবা ছড়াতে লিখছেন ‘বাংলা সন হাজার বছরের ঐতিহ্য’ তারা কি তা বাস্তবিকই জেনেবুঝে লিখছেন? নাকি বহুল আলোচিত সমালোচিত দুটি শব্দ ” হুজুগে বাঙালি ” বা বাংলাদেশিয়ো হয়ে অর্থহীন নেচে যাচ্ছেন।
বাংলা সন ও পহেলা বৈশাখ সম্বন্ধে পুরোনো বইপত্রাদি পাঠে যতটুকু জানতে পেরেছি তা হলো পাঁচশ বছর আগেও এদেশে বাংলা সনের কোনও অস্তিত্ব ছিল না।

সুতরাং বলতেই পারি পাঁচশ বছর আগে বাংলাদেশি তথা পুরো বাঙালি জাতি পহেলা বৈশাখ কিংবা বাংলা সনের সঙ্গে পরিচিত ছিল না। সুলতানি শাসনামলের পর পুরো ভারতে যখন মুঘল শাসনামল শুরু হয় সে সময়ের সম্রাটরা তখন হিজরি পঞ্জিকা (অর্থাৎ তিথি নক্ষত্র তারিখ প্রভৃতিজ্ঞাপক পুস্তক) অনুসারে প্রজাদের নিকট থেকে কৃষিপণ্যের রাজস্ব আদায় করতেন। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের মুখাপেক্ষী হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে রাজস্ব পরিশোধ করতে বাধ্য করা হতো এবং তা সময়মতো পরিশোধ
না হলে তাদের ওপর শুরু হতো
শাসন-শোষণ ও নিপীড়ন।

রাজস্ব আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যেই সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাট মূলত পুরোনো বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। এই আদেশ মতে সে সময়ের বিশেষ প্রসিদ্ধি অর্থাৎ ভারতখ্যাত (অনেকেই যার নাম ও কীর্তির কথা জানেন ) জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন।

১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬ বা ৯৬৩ হিজরি) থেকে । প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন অর্থাৎ ফসল তোলার কাল থেকে গণনা করা হয় এমন একটি সন যা পরবর্তীতে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি লাভ করে।

বাংলা সন মুখ্যত রাজস্ব আদায়ের ফলসহ অন্যান্য সুবিধার্থে সম্রাট আকবর কর্তৃক হিজরি ৯৬৩ অব্দে (১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) প্রবর্তিত হয়। সে সময়ে প্রত্যেকেই বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এর পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটিই পরবর্তীতে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে।

তা ছাড়া ইতিহাসপাঠে জানা যায়, মুঘল শাসন শেষে অর্থাৎ দেশভাগের পূর্ব পর্যন্ত ব্রিটিশ প্রদত্ত জমিদার, উপ-জমিদারগণ পহেলা বৈশাখে বা সময়মতো রাজস্ব দিতে ব্যর্থ হলে তাদের ওপরে অমানবিক নির্যাতন শুরু করে যা এই ছোট ফিচারে লিখে শেষ করা যাবে না। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের সংবাদ প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে এদেশে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়।

তৎপরবর্তী সময় অর্থাৎ ১৯৬৭ সনের পূর্বে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি। জনপ্রিয় না হওয়ার পেছনে কারণ একটাই ছিল আর সেই কারণ হলো পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি আদতেই বাঙালির কোনো ঐতিহ্য ছিল না, যা জোর করে বাঙালির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এতদ্ব্যতীত ফসলি সন (বাংলা সন) -এর প্রবর্তক সম্রাট আকবর এদেশীয় ছিলেন না। তাঁর ভাষাও বাংলা ছিল না। তিনি ছিলেন মোগল বংশোদ্ভূত।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে এটাই বলা যায় যে, যেহেতু সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রববর্তিত এই ফসলি সন তথা বাংলা সন গণনা শুরু হয় ৯৬৩ হিজরিতে, সেহেতু বর্তমান হিজরি সাল থেকে ৯৬৩ হিজরি পর্যন্ত গণনা করে পিছনে গেলে দেখা যাবে ৫০০ বছরও অতিবাহিত হয়নি।

তাই দ্বিধাহীন বলতে পারি, পহেলা বৈশাখ বাঙালির বা বাংলাদেশিদের হাজার বছরের ঐতিহ্য নয়, নয় নিজস্ব কোনও সংস্কৃতি। পহেলা বৈশাখের ইতিহাস আমাদের জন্যে উৎসবের ইতিহাস নয়, এই ইতিহাস বেদনা ও বর্বরতার ইতিহাস। এই ইতিহাস বাঙালির উপর বিজাতীয়দের উৎপীড়ন ও শাসন-শোষনের ইতিহাস।

নিউজটি শেয়ার করুন :