মো: কালিমুল্লাহ, কক্সবাজার: কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোর ওপর চাপ কমাতে এক লাখ শরণার্থীকে নোয়াখালীর ভাসানচর দ্বীপে উন্নত আবাসস্থলে স্থানান্তরের চেষ্টা করছে সরকার। অনেকদিন ধরেই এই চেষ্টা চলছিল, তবে তা সফল হচ্ছিলো না রোহিঙ্গাদের অনিচ্ছা ও কিছু এনজিও’র বাধার কারণে। তবে দীর্ঘদিন পর স্বেচ্ছায় কিছু রোহিঙ্গা ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছেন। এরকম ১৭টি পরিবারের একটি তালিকা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হাতে পৌঁছেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বাংলা ট্রিবিউন।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের কিছু পরিবার স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের এরকম একটি তালিকা বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্টদের হাতে পৌঁছেছে। তালিকায় ১৭টি পরিবারের নাম আছে। তাদের একটি করে ফরম দেওয়া হয়েছে। যার ওপরে লেখা ছিল ‘ভাসানচরে স্থানান্তরে আগ্রহী বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের তালিকা। ফরমে ছয়টি তথ্যর ঘর রয়েছে।
ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছে এমন পরিবারগুলোর একটি তালিকা পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা। শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) বিকালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা বলেন, “ভাসানচর, রোহিঙ্গাদের কাছে যেটি ঠেঙ্গার চর নামে পরিচিত, ওই দ্বীপে যেতে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে এখন বেশ সম্মতি পাওয়া যাচ্ছে। এটি ভালো লক্ষণ। তবে যে তালিকা হাতে পেয়েছি সেটি এখনও চূড়ান্ত নয়। বিষয়গুলো সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠছে সেটা ভালো, তবে এখন দেখবার বিষয় তাদের এই আগ্রহ কতদিন থাকে।”
এবিষয়ে জানতে চাইলে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহাবুব আলম তালুকদার বলেন, “ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের তালিকা নেওয়া হচ্ছে। সেটি এখনও চলমান রয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এটা অত্যন্ত ভালো দিক, যে তারা স্বেচ্ছায় সেখানে যাওয়ার জন্য সম্মতি জানাচ্ছে।” তবে এখন পর্যন্ত কতজন রোহিঙ্গা ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছে, সেটি বলেননি তিনি।
টেকনাফের লেদা, নয়াপাড়া ও জাদিমুরা রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে, সেখানকার বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে কথা বলেও এই তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে বলেও ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। এমনকি শুক্রবার জুমার নামাজের পর এসব ক্যাম্পের মসজিদগুলোতে ভাসানচরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের উৎসাহিত করা হয় বলেও ওই প্রতিবেদনে জানা গেছে।
রোহিঙ্গারা জানান, গত বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) বিকালে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধি, পুরনো-নতুন ১৫ জন রোহিঙ্গা নেতা, জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএমসহ কিছু এনজিও কর্মকর্তা ভাসানচরে যাওয়ার বিষয়ে একটি বৈঠক করেন। সেখানে রোহিঙ্গা নেতাদের নিজ নিজ শিবির থেকে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে বলা হয়েছে। এসময় তাদের কাছে ফরম দেওয়া হয়। এর আগেরদিন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহাবুব আলম তালুকদার লেদা ক্যাম্প ঘুরে দেখেন বলে জানিয়েছেন তারা।
স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছেন বলে জানিয়েছেন নুর হোসেন (৫০) নামে এক বৃদ্ধ রোহিঙ্গা। তিনি বলেন, “ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের জন্য তৈরি করা ঘর-বাড়িগুলোর ভিডিও মোবাইল ফোনে আমাদের দেখিয়েছেন ক্যাম্প ইনচার্জ। এগুলো দেখে মনে হয়েছে সেখানে গিয়ে বসবাস করা রোহিঙ্গাদের জন্য ভালো হবে। ফলে পরিবারের চার সদস্যসহ আমি যেতে রাজি হয়ে তালিকায় নাম দিয়েছি। তবে সেখানে যাওয়ার আগে যদি একবার ঘুরে এসে সেখানকার অবস্থা এখানখার রোহিঙ্গাদের বোঝানো যেতো, তাহলে আরও অনেকে ভাসানচরে যেতে রাজি হতো বলে মনে করি।”
টেকনাফ লেদা ডেভেলপমেন্ট কমিটির প্রধান রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ আলম বলেন, “আমার শিবির থেকে বেশ কিছু পরিবার ভাসানচরে যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। বিষয়টি রোহিঙ্গা সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। তবে ভাসানচরে উন্নত আবাসস্থল থাকার বিষয়টি রোহিঙ্গাদের ভালো করে বোঝানো গেলে সেখানে যেতে ইচ্ছুকদের পরিমাণ বাড়বে।”
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ রবিউল হাসান বলেন, “এখানে অবস্থানকারী বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা এই অঞ্চলের জন্য অনেক বড় রকমের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি এখান থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাও সরানো যায়, তাহলে কিছুটা হলেও বোঝা কমবে। রোহিঙ্গারা যে এখন স্বেচ্ছায় সেখানে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠছে সেটা বেশ ভালো দিক।”
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের পরিবর্তে ভাসানচরকে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে দেখছে কিনা এবং তারা সেখানে গেলে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আরও বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে কিনা- এই প্রশ্নের জবাবে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহাবুব আলম তালুকদার বলেন, “এরকম কোনও আশঙ্কা করছি না। রোহিঙ্গারাতো বোঝে বাংলাদেশে তাদের স্থায়ীভাবে থাকা সম্ভব না। মিয়ানমারও তাদের জন্য এখন নিরাপদ হয়ে উঠছে। কক্সবাজার এলাকার চাপ কমানোর জন্য এবং রোহিঙ্গারা যাতে একটু ভালোভাবে থাকতে পারে সেজন্যই তাদের ভাসানচরে নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। তবে এটা স্থায়ী কোনও ব্যবস্থা নয়। এরজন্য প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত হবে না।”
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে প্রথম ভাসানচরে শরণার্থীদের বসবাসের জন্য আবাসন গড়ার পরিকল্পনা করা হয়। সেসময় চরটিতে কোনও জনবসতি ছিল না। ২০১৭ সালের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে সহিংসতা বৃদ্ধির পর মিয়ানমার থেকে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ ভয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় পালিয়ে আসে। এরপর কক্সবাজারের ওপর চাপ কমাতে ভাসানচরে অবকাঠামো গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন।