লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি :
লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীতে যেন ইলিশ শিকারের ধুম চলছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রতিদিনই দলবদ্ধ হয়ে নদীতে নামছেন জেলেরা। প্রশাসনের জোরালো তদারকির অভাব ও উপকূলীয় এলাকার জনপ্রতিনিধিদের মদদে নদীতে অবাধে মাছ শিকার চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে জেলার বিভিন্ন গ্রামে ভ্যান ও রিকশাযোগে ফেরি করে ইলিশ বিক্রি করতে দেখা গেছে জেলেদের। এর মধ্যে জাটকা কিংবা মা ইলিশও রয়েছে। তুলনামূলক কম দাম হওয়ায় ক্রেতারাও সেগুলো লুফে নিচ্ছে।
অন্যদিকে স্থানীয় প্রশাসনের দায়সারা অভিযানে গত ১১ দিনে ৫৭ জন জেলেকে আটক করা হয়েছে। এ সময় ৮২৫ কেজি ইলিশ জব্দ করা হয়। আটক জেলেদের বিভিন্ন মেয়াদে জেল-জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তবে আটক জেলেদের ভাষ্য মতে, কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়ে নদীতে মাছ ধরতে যাচ্ছেন তাঁরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সপ্তাহ ধরে লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের সমসেরাবাদ, লামচরী, শাকচর, চররুহিতা, রায়পুরের বামনী, সাগরদি, শিবপুর, দেনায়েতপুর, কমলনগরের কালকিনি, চরমার্টিন, চরলরেঞ্চ, রামগতির সবুজগ্রাম, আলেকজান্ডারসহ বিভিন্ন গ্রামে ফেরি করে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ।
প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত রিকশা ও ভ্যানযোগে মাছ বিক্রি করছেন জেলেরা। প্রকাশ্যে ইলিশ বেচাকেনা চললেও এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের যেন নজর নেই। রামগতির জারিরদোনা খাল, বাতিরখাল, কমলনগরের মতিরহাট, কালকিনি, সদরের চররমণী, রায়পুরের চরকাছিয়াসহ মেঘনা নদীর বিভিন্ন এলাকায় গতকাল বিকেলেও মাছ ধরা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্র জানায়, জাটকা সংরক্ষণ ও ইলিশের অভয়াশ্রম হওয়ায় লক্ষ্মীপুরের আলেকজান্ডার থেকে চাঁদপুরের ষাটনল পর্যন্ত মেঘনা নদীর ১০০ কিলোমিটার এলাকায় মার্চ-এপ্রিল দুই মাস নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জেলেরা মাছ শিকারে যাচ্ছে। ২৯ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে বুধবার বিকেল পর্যন্ত মৎস্য প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও কোস্ট গার্ডের অভিযানে ৫৭ জেলেকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে আটজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড, বাকিদের কাছ থেকে তিন লাখ ৪৮ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এ সময় আট লাখ ২০ হাজার মিটার জাল জব্দ করে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। জালগুলোর বাজারমূল্য আনুমানিক ২১ লাখ টাকা। অভিযান চালিয়ে ৮২৫ কেজি ইলিশ জব্দ করা হয়েছে। পরে সেগুলো জেলার বিভিন্ন এতিমখানা ও অসহায়দের মাঝে বিতরণ করা হয়।
বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য মতে, লক্ষ্মীপুর জেলায় প্রায় ৬২ হাজার জেলে রয়েছে। এর মধ্যে ৫০ হাজার ২৫২ জন নিবন্ধিত। কিন্তু মার্চ-এপ্রিল নিষেধাজ্ঞার এই দুই মাস ২৪ হাজার ৬৩০ জেলে সরকারি খাদ্য সহায়তা পাবেন। বাকি জেলেরা কার্ডধারী হলেও খাদ্য সহায়তা পাচ্ছেন না। আবার এসব জেলে নিষেধাজ্ঞার এই সময় অন্য কোনো কাজও করেন না। এ জন্য দাদনদার ও আড়তদারদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সংসার চালাতে হয়। পরে দাদনদার ও আড়তদারদের চাপে পড়ে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে মাছ শিকারে যাচ্ছেন তাঁরা।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সবুজ বাংলাদেশে’র সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বাবু বলেন, প্রশাসনের তদারকির অভাবে গ্রামে গ্রামে এখন ফেরি করে ইলিশ বিক্রি করা হচ্ছে। অভিযান নিয়ে আরো প্রচার-প্রচারণা ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা পরিষদের এক চেয়ারম্যান বলেন, মৎস্যসম্পদ বৃদ্ধির জন্য সরকার জেলেদের খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও নদীতীরের জনপ্রতিনিধিদের মদদে জেলেরা অবাধে নদীতে নামছেন। এতে সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘অভিযান সফল করতে প্রত্যেকটি মাছঘাট ও বরফকল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জেলেরা পর্যাপ্ত মাছ পাওয়ায় এখন কেউ কেউ গোপনে নদীতে যাচ্ছে। খবর পেলে আমরা অভিযান পরিচালনা করি। ইতিমধ্যে ৫৭ জনকে জেল-জরিমানার আওতায় আনা হয়েছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’