শিরোনাম

লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের রাজনীতির হালচাল, আওয়ামীলীগে বিভক্ত-বিএনপিতে নীরবতা

কাজী মোঃ ইউনুছ ও আমানত উল্যাহ,কমলনগর (লক্ষ্মীপুর) 

লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসনে বিএনপির ও আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। জাতীয় দিবসগুলোতে আঃলীগ নিরুত্তাপ কিছু কর্মসূচির আয়োজন করলেও নিষ্ক্রিয়তার কারণে বিএনপি তাও করতে পারেনা। বড় দুটি রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কাজের এমন গতি দেখে উভয় শিবিরের তৃণমূলে নেমে এসেছে চরম হতাশা।

বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের এমন দুরাবস্থায় উদ্বিগ্ন নেতাকর্মীরা। বিএনপি নেতারা বলছেন,ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনের রোষানলে পড়ে মামলা হামলায় জর্জরিত হয়ে রাজপথ থেকে অনেকটা দূরে সরে যান তারা। তবে ক্ষমতাশীন দলের মধ্যে ক্ষমতা-পদপদবী ও ভাগবাটোয়ারা নিয়ে নানা গ্রুপিং,কোন্দলে জড়িয়ে পড়েন তারা। মূলদল আওয়ামীলীগ থেকে সম্পুর্ন বিচ্ছিন্ন যুবলীগ,ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগ ও কৃষকলীগ সহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠনগুলো।

সামনের জাতীয় নির্বাচন নিয়েও বিএনপি ও আঃলীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে তেমন দৌড়ঝাঁপ নেই। নেতারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। কর্মী সমর্থক ও তৃনমুলের নেতাকর্মীদের খোঁজ খবর নেয়া তো দুরের কথা দলের বিভেদ গ্রুপিং ও কোন্দল নিরসনের কোনো চেষ্টা নেই তাদের। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মধ্যে নানা ভাইলীগ সৃষ্টি করে নিজের আখের গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত তারা। দল নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই এমন অভিযোগ তৃনমূলের নেতাকর্মীদের। সবমিলিয়ে স্বস্তিতে নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ। এর কারণ দলীয় কোন্দল ও বিভক্তি।

একে অপরের বিরুদ্ধে নানা বক্তব্য ও ভাইলীগ সৃষ্টি করে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে দলটিতে। লক্ষ্মীপুর-৪ আসনটি রামগতি-কমলনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত। দুই উপজেলায় ১৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা রয়েছে। বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ১০ হাজার ৮৪৭ জন। এরমধ্যে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৮১ নারী ও ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৬৬ জন পুরুষ। আওয়ামীলীগর বিভিন্ন সূত্র বলছে,বর্তমান সাংসদ ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অবঃ) আবদুল মান্নানের প্রতিনিধি হিসেবে কমলনগর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মাস্টার নুরুল আমিন ও রামগতি উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুল ওয়াহিদ মিলে বিভিন্ন প্রকল্প বন্টন সহ সরকারি সুযোগ সুবিধা নিজদের পছন্দের লোকদের দিয়ে পরিচালনা করা নিয়ে চলছে স্নায়ু যুদ্ধ।

অন্যদিকে উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মাস্টার নুরুল আমিনের সাথে স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক মেজবাহ উদ্দিন বাপ্পী ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফয়সল আহমেদ রতন গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আব্দুল্লাহ আল মামুন এমপি হওয়ার পর উপজেলা আঃলীগের সভাপতি মাস্টার নুরুল আমিনের সাথে বিরোধ শুরু হয়। প্রান্তিক নেতা কর্মীদের অভিমত,পুরোদস্তুর প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুন ২০১৪ সালে অনেকটা ‘কৌশলে’ দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দুটি উপজেলায় সাংগঠনিক কাঠামোতে ফাটল সৃষ্টি করে প্রায় ৭ বছর যাবত এ বিবেদ অন্তর্দ্বন্ধ গ্রুপিং জিয়য়ে রেখেছেন।

তার আগে এই আসনে গ্রুপিংয়ের রাজনীতির প্রচলন ছিলনা। তিনি মূলত এ আসনের সাবেক সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় নেত্রী ফরিদুননাহার লাইলির ‘একচ্ছত্র বলয় ‘ হিসেবে পরিচিত আসনটিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে লাইলীকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন বলে অনেক নেতাকর্মীর মন্তব্য। এই নিয়ে আবদুল্লাহ আল মামুন ও লাইলীর অনুসারীরা প্রকাশ্যে গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে পড়েন। আওয়ামীলীগের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল মামুন ও কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ নেত্রী বেগম ফরিদুন্নাহার লাইলীর অনুসারীদের মধ্যে শুরু হয় নানা দল উপদলে বিভক্তি। তাঁদের বিরোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে। প্রায় সবকটি ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অনুগত ব্যক্তিদের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানোর অভিযোগ রয়েছে আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে।

তবে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিতে মোটা অংকের মনোনয়ন বাণিজ্য করা সহ জনবিচ্ছিন্ন লোকদের মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে চলে সমালোচনার ঝড়। ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যের সাথে জেলা-উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি-সম্পাদকের নাম আলোচনায় আসে। সাবেক এমপি আব্দুল্লাহ আল মামুনের অনুসারীরা অভিযোগ করেন,কমলনগর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মাস্টার নুরুল আমিন রামগতি উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে দলে এনে পদপদবী দিয়ে পুনর্বাসন করেন। তবে আব্দুল্লাহ আল মামুনের সাথে রামগতি উপজেলা আওয়ামীলীগের কিছুটা সম্পর্ক থাকলেও কমলনগরে মামুনের সাথে উপজেলা আওয়ামীলীগ নেতাদের সম্পর্ক নেই।

এক্ষেত্রে উভয় উপজেলায় আঃলীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে আঃলীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী বেগম ফরিদুন্নাহার লাইলীর।আবার রামগতি-কমলনগর উপজেলার নেতাকর্মীদের দাবি- সাবেক এমপি আবদুল্লাহর রাজনৈতিক কোন পরিচয় নাই। যখন যেদল ক্ষমতায় আসে তখন সে দলের সাথে লিঁয়াজো করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। সুযোগ বুঝে মনোনয়ন লবিস্ট নিয়োগ করে মনোনয়ন হাসিল করে উড়ে এসে জুড়ে বসার মত। তিনি ২০১৪ সালে এমপি নির্বাচিত হন। এআসনে আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী জোট থেকে মেজর (অবঃ) আবদুল মান্নান,সাবেক এমপি আব্দুল্লাহ আল মামুন,বেগম ফরিদুন্নাহার লাইলী,যুবলীগ নেতা তাসবীরুল হক ও আব্দুজজাহের সাজুর নাম আলোচনায় রয়েছে।

এদিকে দলের অসহায় নেতাকর্মী ছাড়াও জনগনের যেকোন সমস্যায় ফরিদুন্নাহার লাইলীর পক্ষে নানা দান অনুদান বিতরণ করতে দেখা গেছে বিশিষ্ট শিল্পপতি ডঃ আশ্রাফ আলী চৌধুরী সারুকে। ড. সারু রামগতি উপজেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি। একজন ক্লিন ইমেজের নেতা হিসেবে বেশ পরিচিত তিনি। এর মধ্যে ফরিদুন্নাহার লাইলী,তাসবীরুল হক অনু ও আব্দুজজাহের সাজুকে রামগতি-কমলনগরের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে নানা দান অনুদান বিতরণ করতে দেখা গেলেও আব্দুল্লাহ আল মামুনকে জনগনের পাশে দেখা যায়নি। তিনি মাঝে মধ্যে এলাকায় আসলেও গোপনে আবার ঢাকায় চলে যান। নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সাথে তার তেমন দেখা সাক্ষাৎ নেই। বর্তমানে আবদুল্লাহ আল মামুন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তৃণমূল কর্মীদের শঙ্কা রাতের অন্ধকারে তিনি অর্থের বিনিময়ে আবারো দলীয় মনোনয়ন লাভের চোরাগলি খুঁজছেন হয়তো!

নীরব নির্জীব বিএনপি:
বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে তেমন তৎপরতা নেই। দলীয় নেতা-কর্মীরা বলছেন,চেয়ারপারসন কারাগারে। ঘরোয়াভাবেও কোনো কর্মসূচি পালনের সুযোগ নেই। এ অবস্থায় সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করাটা খুবই কষ্ট হচ্ছে । আর রাজপথে কোন কর্মসূচি দিতে দিচ্ছেনা আওয়ামীলীগ ও প্রশাসন। মামলা-হামলায় জর্জরিত হয়ে পড়ে বিএনপির নেতা কর্মীরা।এরই মধ্যে দুএকটি ইউনিয়নে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করা নিয়ে দলের মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। একে অপরকে সমর্থন না দিয়ে অনেকটা নিরবতা পালন করেন তৃনমুলের কর্মীরা। সাংগঠনিক কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ায় দেশের বৃহৎ এই দলের মধ্যে নেমে এসেছে চরম হতাশা।

কমলনগর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা চৌধুরী বলেন, এতো মামলা হামলা ও নির্যাতনের পরেও রামগতি-কমলনগরে বিএনপি ঐক্যবদ্ধ। প্রশাসন ও ক্ষমতাশীনরা তাদেরকে নানা ভাবে কোনঠাসা করে রেখেছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ আসনে বিএনপির সাবেক দুই বারের সাংসদ এবিএম আশ্রাফ উদ্দীন নিজানের সাথে রামগতি-কমলনগরের জনগন ও দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে রয়েছে গভীর সম্পর্ক। করোনা মহামারী সহ বিভিন্ন সময়ে আশ্রাফ উদ্দীন নিজান দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মাঝে নানা দান অনুদান ও নগদ টাকা বিতরণ সহ সুখে দুঃখে এগিয়ে আসেন আশ্রাফ উদ্দীন নিজান।

এতে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে ব্যাপক । তবে দলীয় সূত্র জানায়,এ আসনে আগামী নির্বাচনে বিএনপি জোট থেকে সাবেক সাংসদ এবিএম আশ্রাফ উদ্দীন নিজান, জেএসডির সভাপতি আসম আব্দুর রবের নাম আলোচনায় থাকলেও তৃণমূল নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ আশ্রাফ উদ্দীন নিজানকেই চাচ্ছেন। তিনি একজন ক্লিন ইমেজের নেতা ও জনবান্ধন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আশ্রাফ উদ্দীন নিজানের মতে আ স ম আব্দুররব বিএনপির কেউ নয়।গত নির্বাচনে তাকে ছাড় দেওয়ায় তিনি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন।এবার তাকে কোন ছাড় দেওয়া হবেনা বলে জানান আশ্রাফ উদ্দীন নিজান।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, হাতপাখা:

বড় দুটি রাজনৈতিক জোটের বাহিরে এ আসনে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সাংগঠনিক কার্যক্রম চোখে পড়ার মতো। দুই উপজেলার সবকটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে রয়েছে মজবুত কমিটি। স্থানীয় ইউপি নির্বাচনে দলটি হাতপাখা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে একটি ইউনিয়নে বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান হন। বাকি ইউনিয়নগুলোর কোথাও ২য় আবার কোথাও তৃতীয় স্থান অর্জন করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে দলটি থেকে মুফতী শরীফুল ইসলাম হাতপাখা প্রতীক নিয়ে সম্মানজনক ভোট পেয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে আলোচনায় আসেন দলটি। অন্যদিকে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ এ আসনে রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা চালান। নদী ভাংগন সহ নানা ইস্যুতে রাজপথে নানা কর্মসুচি পালন করতে দেখা গেছে বাসদকে।

নিউজটি শেয়ার করুন :