আ স ম আবু তালেব, বিশেষ প্রতিনিধিঃ
মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে আলোচিত স্কুলছাত্র নিরব (১৫) হত্যার দুই বছর পূর্ণ হলেও সঠিক বিচার পায়নি পরিবার। ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় লৌহজং উপজেলার পদ্মা সেতুর কুমারভোগ পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসা থেকে ডেকে নিয়ে খুন করা হয় এসএসসি পরীক্ষার্থী নিরবকে। পরদিন ৩১ জানুয়ারি কুমারভোগ পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দা নাঈম খানের পুত্র নিরবের গলা কাঁটা অবস্থায় কেন্দ্রের উত্তর-পশ্চিম পাশের ডোবা থেকে মরদেহ উদ্ধার করে লৌহজং থানা পুলিশ। এর দুদিন পরেই নিরবের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার কথা ছিল। এ ঘটনায় লৌহজং থানায় মামলা দায়ের করে পরিবার।
নিরব নিখোঁজের রাতেই রাব্বি ও আলাল নামে দুজনকে এবং নিরবের বাবার সহযোগিতায় পরে অভিযুক্ত আরিফকেও আটক করে থানা পুলিশ। আনোয়ার চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের আলোচিত স্কুলছাত্র নিরব হত্যার সুষ্ঠু বিচার চেয়ে তখন স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ও এলাকাবাসী মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করে। পুলিশের দুর্বল ও অসঙ্গতিপূর্ণ চার্জশিটের কারণে বাদী নাঈম খান নারাজি দেওয়ায় মামলার তদন্তের ভার দেওয়া হয় সিআইডির (অপরাধ তদন্ত বিভাগ) উপর।
কিন্তু এতেও মামলার গতি এগোয়নি বলে জানান নাঈম খান। তিনি আরও জানান, ওই সময় আসামি আরিফের বাসায় হত্যার অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলামত ছিল। সে সময় পুলিশকে জানালেও সেসব উদ্ধার করেনি তারা। নিরব হত্যার এক বছরেও খুনের আলামত উদ্ধার করতে আসেননি পুলিশ। সে সাথে ঘরে থাকা আলামত নষ্টসহ খুনের আরও বেশ কিছু আলামত চার্জশিটে বাদ দিয়ে মামলা হালকা করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আর এমন অভিযোগ দিয়ে নিরবের বাবা নাঈম খান আলোকিত বাংলাদেশকে জানান, নিরবকে হত্যা করার পরে আকাশের নিজ বাসায় আরিফ ও আকাশ রক্তমাখা জামাকাপড় পরির্বতন করেন। ১০-১২ দিন পরে লৌহজং থানার এসআই হারুন-আর-রশিদ সে ঘরে তালা দেয়। আমি অনেকবার লৌহজং থানা পুলিশকে বলেছি সে ঘর থেকে রক্তমাখা জামাকাপড়সহ খুনের আলামতগুলো উদ্ধার করে নিতে। কিন্তু প্রথম একবছর পরেও পুলিশ সেসব আলামত উদ্ধার না করায় খুনের আলামতগুলো ঘরের তালা ভেঙ্গে নষ্ট করে দেয় আরিফের মা নেছা বেগম (৫০), মামা ও আলালের কাকা জুলহাস বেপারী (৫৫)। গত এক বছরে আরিফের পরিবার সে ঘর সরিয়ে নিয়ে গেছে।
নিরবের বাবা নাঈম খান আরও জানান, নিরব নিখোঁজ হবার রাতে পুলিশ আরিফের মায়ের কাছ থেকে আরিফের এবং রাব্বির কাছ থেকে রাব্বির মোবাইল ফোন উদ্ধার করে। কিন্তু এ মোবাইল ফোনের কথাও চার্জশিটের কোথাও উল্লেখ্য করা হয়নি। তিনি আরও জানান, আলালের বাসার কাছ থেকে ফোঁটাফোঁটা রক্ত আমি নিজে (নিরবেব বাবা) পলিব্যাগে তুলে দেই। এ রক্তের কথাও চার্জশির্টে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। সে সাথে আরও একটা কথা না বললে নয়, আসামিদের বয়স চার্জশিটে দেওয়া হয়েছে অনেক কম, সত্যিকারার্থে আসামিদের বয়স আরও বেশি হবে। তিনি আরও বলেন, পুলিশ ইচ্ছে করলে সব করতে পারে, কিন্তু আসামি ইমতিয়াজ ও আকাশের সন্ধান এক বছরেও পায়নি।
নিরবদের বাড়িতে গেলে নিরবের চাচা টিটু খান জানান, নিরবের মা শিউলি বেগম একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে এখনও উদ্ভ্রান্তের মতো কান্নাকাটি করেন। দুই বছরে এক মুহূর্তের জন্যও তারা ছেলেকে ভুলতে পারেননি। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে শিউলি বেগম বলেন, আপনারা আমার ছেলে হত্যার কিছুই করতে পারলেন না। পুলিশ ইচ্ছে করলে হত্যাকারীদের ফাঁসি দিতে পারতো। নিরবের অশীতিপর দাদী হাসিনা বেগম জানান, আমার নাতি নিরবকে আমার সামনেই রাব্বি, আরিফ ও আলাল ডেকে নিয়ে যায়। সারা রাত নিরবকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া যায়নি। পরের দিন পাশের ডোবা থেকে নিরবের লাশ পাওয়া যায়। মরার আগে আমি আমার নাতি হত্যার বিচার দেখে যেতে চাই।
মামলার প্রধান আসামি রাব্বি (১৯), দুই নম্বর আসামি আলাল (২০) এবং তিন নম্বর আসামি আরিফকে (২১) পুলিশ আটক করলেও তারা জামিনে বেরিয়ে আসে।
এদের মধ্যে রাব্বি ও আলাল পরিবারসহ পলাতক রয়েছে। তারা মামলার তারিখেও হাজির হয় না। আরিফ প্রথম দিকে হাজিরা দিতে গেলেও এখন সে আদালতে তারিখের দিনেও যায় না। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (সিআইডি) দীপক কুমার শিকদার আলোকিত বাংলাদেশকে জানান, সনদ বানিয়ে এনে আসামি আরিফের বয়স ১৭ বছর দেখানো হয়েছে। আমরা আদালতে চ্যালেঞ্জ করেছি। তার বয়স অনেক বেশি হবে। তিনি আরও জানান, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আরিফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত রাব্বি ও আলাল ছাড়াও দুযুবক আকাশ, ইমতিয়াজের সাথে টিজে নামে এক তরুণীর নাম উল্লেখ করে। আসলে নিজেরা বাঁচার জন্য শেষোক্ত তিনজনের নাম বলেছে আরিফ। বাস্তবে এদের অস্তিত্ব নেই।
লৌহজং থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আলমগীর হোসাইন বলেন, মামলাটি সিআইডির কাছে ন্যস্ত করা হয়েছে। এখন আমাদের কিছুই করার নেই। এরপরেও আদালত কোনো নির্দেশনা দিলে কিংবা সিআইডি সহযোগিতা চাইলে আমারা তা করব।