শিরোনাম

(১ম খন্ড অনুগল্প) একজন রিক্সাচালকের দুঃস্বপ্ন-৪ চতুর্থ অংশ: মোস্তফা হারুন, সহ. পুলিশ সুপার

 

ওহ হ্যাঁ, অপজিশনের কথা বলছেন? এটা বলার আগে আমি একটি বিষয় ব্যাখ্যা দিব তাহলো, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় গোটা জাতিকে একত্রিত করেছিলেন বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব এবং জাতিকে স্বাধীনতার যুদ্ধের জন্য অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন এবং শেষ অবদি পাকিস্থানীদের কারাগারে তার স্থান হয়েছিল। সেদিন যদি তিনি জাতিকে দিকনির্দেশনা না দিয়ে যেতেন,জাতি তার গন্তব্য সম্পর্কে জানতে পারতো না।

উনার মত মহান নেতা জাতিকে সংগবদ্ধ করতে পেরেছিলেন বলেই বাংগালী আজ স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বাদ পেয়েছে। পরবর্তীতে মহান নেতাকে কতিপয় বিপথগামী সেনাবাহিনীর সদস্যগন স্বপরিবারে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি। বেঈমান মোস্তাক ক্ষমতা দখল করে নেয় এবং মোস্তাকের নেতৃত্বে তৎকালীন আওয়ামী লীগ এর অনেক নেতাই মোস্তাক আহম্মদের মন্ত্রী সভায় যোগ দিয়েছিল। ঘড়ের শত্রু যদি বিভিষন হয় তাহলে কিইবা আর করার থাকে। এরপরে কিন্তু কোন নেতাই আর জাতিকে একতাবদ্ধ করতে পারেনি।

গনতন্ত্রের আড়ালে বহুদলীয় শাসন ব্যাবস্থা চালু হলেও জাতি আর একত্রিত হতে পারেনি। জাতি বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটকিয়ে যায়। জাতি যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে অবস্থান নেয় তখন বহিঃশক্তির আবির্ভাব ঘটে এবং তাদের প্রভাব বিস্তার করে একটি স্বাধীন রাস্ট্র এর মৌলিক বিষয়গুলোর উপর হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায়। এতে করে দেশের আভ্যন্তরীণ কাঠামো ভেংগে পরার ভয় থাকে। ধীরে ধীরে ক্ষমতাসীন দল তার জনপ্রিয়তা দ্রুত হারিয়ে ফেলে এবং তাদেরকে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উপর নির্ভরশীল হতে হয়।

আমি সে সুযোগ দিতে চাইনা আমার রাস্ট্র পরিচালনায় অবশ্যই অপজিশনের উপর দমন পীড়ন না করে তাদেরকে কাছে টেনে নিয়েই একসাথে পথ চলতে চাই। আমি অপজিশনের সাথে শত্রুতা বাড়িয়ে দেশকে অন্য রাস্ট্রের হস্তক্ষেপের সুযোগ দিতে চাইনা। এক্ষেত্রে আমি মহান নেতা বংগবন্ধুর নীতি অনুসরণ করতে চাই। আবার দেশের মানুষ একত্রিত করতে হবে।

তা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। অপজিশনের অংশীদারত্বের দরকার আছে। ইতিমধ্যে বহির্ভূত দেশ গুলো আমাদের দেশকে নিয়ে চক্রান্ত শুরু করে দিয়েছে। আমাদেরকে আবার দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ করতে চায়। আমি সেই সুযোগ দিতে চাইনা। এবার হয়তো বুঝতে পেরেছেন অপজিশন নিয়ে আমার ভাবনা কেমন।

উপস্থাপকঃ স্যার,আপনার চিন্তাধারা অত্যান্ত পরিস্কার এবং এটা একটা যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত হবে ইনশাআল্লাহ। এখন জানতে চাই শ্রমজীবিদের নিয়ে কি ভাবছেন?

প্রধানমন্ত্রীঃ দেখুন শ্রমজীবীদের জন্য আমার একটা সফট কর্ণার আছে। বিশেষ করে রিক্সা চালক,ভ্যান চালক,ঠেলা গাড়ী চালক ইত্যাদি। তাদের জন্য শ্রমিক পল্লী নামক একটা আবাসিক প্রকল্প হাতে নিব এবং তারা যাতে যাবতীয় নাগরিক সুবিধা পায় সেদিকে নজর দেয়া হবে। তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্টান করে দেয়া হবে। শিক্ষার ক্ষত্রে তাদের বিনামুল্যে শিক্ষার সুযোগ পাবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও তারা বিনা খরচে পড়ার সুযোগ পাবে।

তাদের ছেলেমেয়েদেরকে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেশি সুযোগ করে দেয়া হবে এবং বিদেশে চাকুরির ব্যাবস্থা করে দেয়া হবে। যেন তারাও রাস্ট্রের বৈদেশিক মুদ্রার উৎস হয়ে উঠতে পারে। যাহোক অনেক কথা হলো, পরে আবার সুযোগ পেলে আমি আমার আরও পরিকল্পনার কথা আপনাদের মাধ্যমে জাতির কাছে পৌঁছে দিতে চাই।

পুলিশ, জেলা প্রশাসন, মন্ত্রীদের প্রটোকল ও আবাসন নিয়ে আমি এবার আমার অবজারভেশন তুলে ধরছি। আশা করি আমার অবজারভেশন হবে সময়োপযোগী। দেখুন, বৃটিশ শাসনামলে পুলিশের, জেলা প্রশাসনের, মন্ত্রীদের জন্য যে আরাম আয়েশের ব্যাবস্থা করে রেখেছে,তা তাদের সুবিধার জন্য করেছিল।কারণ বৃটিশ শাসনামলের অফিসারগন এসব গুরুত্বপূর্ণ পদ হোল্ড করতো।

এখন বৃটিশেরা নাই,কিন্তু তাদের সেই পদ্ধতি গুলি তারা রেখে গেছে,যা এখন হোল্ড করছে বাংগালী অফিসারগন। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় সেসব অফিসার এখন তাদেরকে সেই আদল থেকে বের করতে চায় না। সুযোগ সুবিধা কে হাতছাড়া করতে চায় বলেন। অথচ এই সব মেইনটেইন করতে সরকারের অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। জনগনও সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ধরুন পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য মন্ত্রীদের কথা বলছি।

এই স্বাধীন দেশে বৃটিশদের মতো কি তাদের বাংলো বাড়ীর প্রয়োজন আছে? এই স্বাধীন দেশে তাদের কি প্রটোকলের প্রয়োজন আছে? এই স্বাধীন দেশে তাদের নিরাপত্তার জন্য বডিগার্ড, আরদালী, ২/৪ করে বাসায় বাবুর্চির প্রয়োজন আছে? আমার দৃষ্টি কোন থেকে আমি ভেবে দেখেছি এসবের কোন প্রয়োজন নেই। এই সব সুবিধা থাকার কারণে তারা নিজেদেরকে জনগন থেকে আলাদা জগতের মানুষ ভাবতে শিখেছে।

উন্নত দেশগুলোর মতো আমি, পছন্দ করি অফিসার নিজের গাড়ী নিজে চালাবে আলাদা ড্রাইভারের প্রয়োজন নেই, নিরাপত্তার জন্য কোন বডিগার্ড দরকার নেই।কারন পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বডিগার্ড, আরদালি নিয়ে ঘুরাঘুরি করে তাহলে জনগন ভাবে পুলিশ হয়ে পুলিশের প্রোটেকশন নিয়ে যদি নিরাপত্তার জন্য চলাফেরা করতে হয় তাহলে তারা জনগনের নিরাপত্তা দিবে কেমন করে।

ডিসিকেও যদি একই কাজ করতে হয় তিনি কিভাবে আশা করে তিনি জনগণের সেবক,তেমনি প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্যান্য মন্ত্রীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এতো বড় বাংলো বাড়ীতে জেলার অফিসারদের কোয়ার্টার করে দেওয়ার প্রয়োজন আছে মনে করি। একজনের জন্য অত বড় বাংলো বাড়ীর প্রয়োজন নেই। তিনি তো বৃটিশ শাসনামলের অফিসার নয় যে,তার প্রানের ভয় আছে। অতিরিক্ত বডিগার্ড, আরদালি প্রত্যাহার করে সেসব পুলিশ সদস্যদের জনসেবায় নিয়োজিত করা উচিৎ বলে আমি মনে করি।

অহেতুক পুলিশের একটি বড় ধরনের জনবল এই আনপ্রোডাক্টিভিটি কাজে ব্যাবহার হচ্ছে। কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জেলা, থানা পরিদর্শনে গেলে জেলার সীমানা থেকে আগেপিছে পুলিশের প্রোটেকশন দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে নিয়ে আসতে দেখা যায়। কেন তা হবে,এই স্বাধীন দেশে তার কি নিরাপত্তার অভাব ঘটেছে নাকি বৃটিশরা করে গেছে বলে আমাদেরও এখনো সেটা বহাল রাখতে হবে?

মাঠপর্যায়ের অফিসারদের জীবনের ঝুকি এতো বেশি যে,তারা তাদের জন্য কখনোই নিরাপত্তার জন্য বডিগার্ড ও প্রটেকশনের প্রয়োজন মনে করেনা। তাহলে যাদের জীবনের ঝুকি নেই তারা কেন এই সব সুবিধা ভোগ করবে? দেশের পুলিশের সিংহভাগই সদস্য এই রকম উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ও মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীদের প্রোটেকশন নিয়ে ব্যাস্ত থাকার কারনে জনগন তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমি এই ব্যাবস্থা প্রত্যাহার করার জড়ালো পদক্ষেপ নিব।

এই রাস্ট্রের একমাত্র ঝুকিপূর্ণ ব্যাক্তি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী যাকে বলে সরকার প্রধান। উনার জীবনাশঙ্কা খুব বেশি। কেননা তাকে ক্যু করতে পারলেই সরকার পরিবর্তন ঘটে যায়। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পদটিতে নিরাপত্তা অধিক জোড়দার করার প্রয়োজন আছে। এছাড়া অন্যান্য মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না। হ্যাঁ, শুধুমাত্র বাহিনীর প্রধানের জন্য এই ব্যাবস্থা প্রত্যাহার করা হবেনা।আমাদের উচিৎ বৃটিশদের রেখে যাওয়া সকল অপকানুন ও অপব্যাবস্থা থেকে বের হয়ে জনবান্ধন পুলিশ বাহিনী গঠন করা।

প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ের সাক্ষাৎকার শেষ, তিনি এখন গনভবনে রওনা করবেন। সরব হয়ে গেলো প্রটেকশন দল। প্রটোকল গাড়ীর ইগনেশন সুইচ অন হয়ে গেল। স্টুডিও থেকে প্রধানমন্ত্রী মহোদয় বেড়িয়ে পতাকাবাহী বুলেট প্রুফ গাড়ীতে উঠে বসলেন। প্রটোকলের গাড়ীগুলোর সাইরেন বেজে উঠলো। গাড়ীর বহর গণভবনের উদ্দেশ্যে রওনা করলো।

গনভবনে পৌঁছে তিনি সবাইকেই বিদায় জানালেন। আগামীকাল অফিসিয়ালী কাজ শুরু করবেন। বাসায় ঢুকে গফুর তার স্ত্রীকে দামি পোশাকে সুসজ্জিত দেখতে পেলো। সন্তান রাজকীয় পোশাক পরিধান করে আছে। প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে। সাওয়ার শেষে নাইট ড্রেস পড়ে গফুর খাবার টেবিলে স্ত্রী পুত্র সহ রাতের ডিনারে জন্য বসেছে।

এদিকে সকাল হয়ে গেছে।১০টা বেজে চলছে।গফুরের ঘুম ভাংছে না।ঘুমের ঘোড়ে মাঝে মাঝে গফুর হাসছে তা খেয়াল করলো গফুরের স্ত্রী। আজ কাজে যাবেনা নাকি!কাজে না গেলে সবাইকেই না খেয়ে থাকতে হবে। তাই গফুরের স্ত্রী গফুরের গা ঝাকিয়ে ঘুম থেকে জাগানোর চেষ্টা করছে এবং ডাকছে ঐ রশিদের বাপ ঘুম হইতে উঠোন লাগবো না?
কাজে যাইবা না? উইঠা পর নাইলে গায়ে পানি ঢাইলা দিমু।

অনেক ডাকাডাকির পরেও গফুরের ঘুম ভাংছে না। গফুর সুখ নিদ্রায় বিভোর। অবশেষে গফুরের স্ত্রী এক বালতি পানি এনে গফুরে গায়ে ঢেলে দিলে গফুর ধরফর করে ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে পড়লো এবং কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে বসে বসে স্বপ্নের কথা ভেবে একা একাই হাসছে এবং মনের ভিতর সুখানুভূতি অনুভব করছে। আর ভাবছে,কই গফুর আর কই প্রধানমন্ত্রী, যদি সত্যি সত্যিই প্রধানমন্ত্রী হতে পারতাম তাহলে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে দিতাম।
(সমাপ্ত)

লেখক- মো: মোস্তফা হারুন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার, ২ এপিবিএন, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।

নিউজটি শেয়ার করুন :