রাতে বাপ মায়ের সাথে খাওয়া দাওয়া সেরে রাশেদ ঘুমিয়ে পরে। সকালে আবার স্কুল আছে। আগামী বছর এস এস সি পরীক্ষা দিতে হবে। তার একমাত্র চিন্তা রেজাল্ট ভাল করতেই হবে। বাপ মায়ের মুখ উজ্জ্বল করতেই হবে। এদিকে গফুর খুব ভোরে আযানের পর নামায সেরেই রিক্সা নিয়ে বের হয়ে যায়। ভোরের দিকে নাইট কোচের যাত্রী পাওয়া যায়। ভাড়া একটু বেশি পাওয়া যায়।
গফুর রিক্সা নিয়া গাবতলী বাসষ্ট্যান্ডের কাছে চলে যায় এবং যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। শ্যামলী নাইট কোচ নওগাঁ থেকে গাবতলীতে এই মাত্রই পৌছিল। দুই জন যুবক টাইপের ছেলে গফুরের রিক্সা দেখে হাক ছাড়ে।
–ঐ খালি যাইবা নাকি?
— কৈ যাইবেন বাপজান?
— মিরপুর -২ চিড়িয়াখানা, রোডে।
–যামু বাপজান।
— ভাড়া কত?
— ১০০ ট্যাহা দিয়েন বাপজান। হক্কাল বেলায় আপনারাই আমার প্রথম কাস্টমার।
— ৯০ রাইখো, লও যাই।
— উইঠা বসেন বাপজান। আপনাগো বয়সের আমার এক পোলা আছে। ওর পড়ালিখার খরচ চালাতেই হক্কাল বেলায় বাইর হইয়া পরছি।
— (রিক্সায় উঠতে উঠতে) তোমার পোলাডা কিসে পড়ে?
— আগামী বছর এস এস সি পরীক্ষা দিবো বাপজান।
— খুব ভাল শুইনা খুশি হইলাম।
কথাবার্তা বলতে বলতে গফুর রিক্সা নিয়া চিড়িয়াখানা রোডে পৌঁছে যায়। যাত্রীদের নামাইয়া দেয়। ছেলে দুইডা ২০০ টাকা বের করে দিয়ে বলে
— আংকেল এই টাকা রাইখা দেন।
— বাপজান ১৯০ ট্যাহা বেশি দিয়া ফ্যালছেন।
— আরে রাখেন আংকেল, আপনার ছেলের জন্যই বেশি দিলাম। ছেলের জন্য আজ ফল কিনে নিয়ে যাইবেন।
ছেলে দুইজন নেমে চলে যায়। সেদিন সকাল ১০ টার ভিতরই গফুর প্রায় ৫০০ টাকার মত কামাই করে ফেলে। আজ তার বড়ই ইচ্ছে ছেলের জন্য আধা কেজি গরুর মাংস কিনে নিয়ে যাবে। আজ সারাদিন গফুরের টার্গেট জমার টাকা বাদ দিয়ে ১০০০ টাকা কামাই করবেই।
দুপুরের দিকে বাজার থেকে ১ কেজি গরুর মাংস,আলু,পেয়াজ,গরম মসল্লা,কিনে নিয়ে বাসায় দিয়ে এসে বউকে বলে এসেছিল রাতে পাক করার জন্য। রাতে রিক্সা গ্যারেজে জমা দিয়ে ফিরে এসে একসাথে খাবে। বাকি সময়টা আরও বেশি রোজগারে জন্য আবার বেরিয়ে পড়েছিল গফুর। আজ তার টার্গেট পুরন হয়েছে। মালিকের টাকা জমা দিবার যাবার পথে তিনজন ইয়াং যুবক গফুরুকে মিল্কভিটার গলিতে পৌঁছে দেয়ার জন্য অনুরোধ করলে গফুর তিন যুবককে নিয়ে রিক্সায় মিল্কভিটার গলির উদ্দ্যেশ্যে রওনা করে।
মিল্কভিটার গলির মাথায় পৌঁছে যুবকেরা রিক্সা থেকে নেমে এক ধারালো ছোরা বের করে গফুরের কাছে যা টাকা আছে বের করে দিতে বলে। গফুর অনেক কাকুতিমিনতি করেও পার পায়নি। টাকা বের করতে দেরি হওয়ায় যুবকেরা গফুরের পেটে ছোরা বসিয়ে দিয়ে জখম করে গফুরের কাছে থাকা ১০০০ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত অন্ধকারে গা ঢাকা দেয়।
গফুর রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পরে বাচাও বাচাও বলে চিৎকার দিচ্ছিল। ঐ পথ দিয়েই গফুরের বন্ধু সবুর যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিল। একজন রিক্সাচালকের চিৎকার শুনে সবুর রিক্সা থামিয়ে এগিয়ে গিয়ে গফুরকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে যাত্রীদের বিদায় দিয়ে, সবুর গফুরের রিক্সার মালিককে মোবাইলে ঘটনা জানায় এবং রিক্সা এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। এদিকে সবুর দ্রুত গফুরকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়।
সবুরের কাছে যা টাকা ছিল,তাদিয়ে গফুরের চিকিৎসা করাতে থাকে। পরবর্তীতে রিক্সার মালিক ঢাকা মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে এসে গফুরের চিকিৎসার দায়িত্ব নেয় এবং সবুর গফুরের বাসায় যায় ভাবিকে হাসপাতালে আনার জন্য। হাসপাতালে পৌঁছে গফুরের বউ বাচ্চা দুই জনের চোখে অশ্রু,মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা করতে ইতিমধ্যে সবুর ও রিক্সার মালিক অনেক খরচ করে ফেলেছে। মালিকটা ভাল ছিল বলেই এই যাত্রায় রক্ষা হয়েছে।
গফুরের স্ত্রী সবুরকে জিজ্ঞাসা করে,
–আচ্ছা ভাই,সরকারি হাসপাতালে তো চিকিৎসার জন্যি ও ঔষধের জন্যি টাকা খরচ হওয়নের কথা নয়। সরকারি হাসপাতালে বিনা পয়সায় চিকিৎসা হওয়নের কথা। কিন্তু আমগো বেলায় ট্যাকা লাগতাছে কেন?
জবাবে গফুর বলে,
— ভাবি সরকারি হাসপাতাল হইলেও এইখানেও গরীবের জন্যি কোন সুবিধা নাই। হাসপাতালের ডাক্তার ও সেবক সেবিকারা মিইলা ঔষধপত্র চুরি কইরা কালোবাজারে বেইচা দেয়।
ওরা এখন শুধু শ্লিপ লিইখা দেয়,বাহির থাইকা ঔষধ কিইনা আনার দায়িত্ব রোগীর। একমাত্র ভি আই পি রোগীদের জন্যি সব সুযোগ সুবিধা বহাল আছে। গরীবের কোথাও শান্তি নাই। মরলেও পোস্টমর্টেমের জন্যি ট্যাকা গুনতে হয়।
সরকার এইদিকে খেয়ালই করেনা। এসব দেখার কথা সরকারের, কিন্তু সরকার উদাসীন এবং অপারগ। দেশে অসৎ লোকেরা এখন সব সুবিধা গ্রহন করে। বঞ্চিত হয় আমাগো আপনাগোর মত সাধারণ জনগন।
যাক ঐসব বুঝবেইন না ভাবি,তাও ভাল যে আল্লাহ গফুরকে নুতন জীবন দান কইরেছেন। আপনারা বাড়ী যান আমি এইখানে আছি। সকালের দিকে রিলিজ দিইয়া দিবো। তখন গফুরকে আমি বাসায় পৌঁছাইয়া দিমুনে। এখন কিছুদিন ঘা শুকানো প্রযন্ত গফুরকে বিশ্রাম নিইতে হইবে এবং ঔষধপত্র ঠিকভাবে খাইতে হইবে। গফুরের স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে বস্তিতে ফিরে আসে।
লেখক- মো: মোস্তফা হারুন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার, ২ এপিবিএন, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।
(চলবে)