শিরোনাম

আত্মবিশ্বাসীরাই বিজয়ী অবিশ্বাসীরা পরাজিতঃ ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

 

মানুষ এখন পা দিয়ে হাটে না, মাথা দিয়ে কিছু  বহন করে না, ড্রাইভার বিহীন গাড়ি, জ্বলানিহীন ইঞ্জিন, মনুষ্যহীন যুদ্ধ বিমান, শব্দহীন ঘাতক বোমা অনেক আগেই আবিস্কার হয়েছে। তৈরী করেছে মানুষের বিকল্প রোবট। এই রোবট জিহ্বার স্বাদ ছাড়া সবকিছুই করতে পারে। এ সবই আবিস্কার করেছেন বিশ্বাসীরাই। একজন সফল মানুষও খোঁজে পাওয়া যাবে না, যে জীবনে ঝুঁকি  নেননি। ঝুঁকি নিতে পারেন আত্মবিশ্বাসী মানুষ। যিনি ভাবেন, আমি পারবো, আমাকে পারতেই হবে। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস হতে আসে সঙ্কল্প ও সাহস। সেখানেই থাকে সাফল্য।

উইলিয়াম হ্যাজনিট বলেছেন, ‘If you think you can win, you can win. Faith is necessary to victory. যদি তুমি মনে করো, তুমি বিজয়ী হবে, তুমি বিজয়ী হবেই। জয়ের পক্ষে জরুরী হলো বিশ্বাস। আত্মবিশ্বাসী মানুষেরাই বড় চিন্তা,সিদ্ধান্ত এবং ঝুঁকি  নিতে পারেন। মানুষ কত বড়? যত বড় চিন্তা তত বড়। একজন বড় চিন্তার মানুষ কী কী করতে পারেন তার কোন সীমারেখা নেই।

সাধারণ মানুষ আর অসাধারণ মানুষের মাঝে বুদ্ধি ও মস্তিষ্কের তেমন পার্থক্য নেই। পার্থক্য হলো আত্মবিশ্বাসের।সাধারণের আত্মবিশ্বাস সাধারণ আর অসাধারণের আত্মবিশ্বাস অসাধারণ। জীবনে সবকিছু হারালেও স্বপ্ন সাহস ও বিশ্বাসের যদি মৃত্যু না ঘটে, সাফল্য তার জীবনে আসবেই।  সমাজে অনেক বড় বড় মেধাবী মানুষ আছে যারা আত্মবিশ্বাসের অভাবে জীবনকে কাজে লাগাতে পারেনি। দেখেনি তারা সফলতার মুখ। আমাদের পরিবারগুলো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, আমলা তৈরী করছে কিন্তু আত্মবিশ্বাসী মানুষ তৈরী করতে পারছে না। আত্মবিশ্বাসের অভাবে তরুণ বয়সের চাষ করা স্বপ্ন স্বাপ্নিক হয়ে উড়ে যায়।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘জগতের যা কিছু উন্নত সব মানুষের শক্তিতে হয়েছে, উৎসাহের শক্তিতে হয়েছে, বিশ্বাসের শক্তিতে হয়েছে’। বিশ্বাসীরা বিদ্যুৎ আবিস্কার করে দূর করে অন্ধকার, রকেট আবিস্কার করে জয় করে মহাকাশ। এই বিশ্বাসীরাই একদিন পৃথিবীর বাইরে  আরো বাসযোগ্য গ্রহ জয় করবে।বিজ্ঞানী নিউটন বলেছেন, আমার আবিস্কারের কারণ প্রতিভা নয়, চিন্তা পরিশ্রম এবং আত্মবিশ্বাস। দার্শনিক ভলতেয়ার বলতেন, প্রতিভা বলতে কিছু নেই, সবই সাধনা আর আত্মবিশ্বাস।

আত্মবিশ্বাসী ছিলেন বলেই তোতলা গ্রীক ডেমোস্থিনিস সমুদ্র তীরে দিনের পর দিন বক্তব্য চর্চা করে সেরা বাগ্মী হন। মহাত্মা গান্ধী শ্রোতাদের সামনে দু’চার কথা বলতে পা কাঁপত। আত্মবিশ্বাস আর সাধনার কারণে তিনি বড় বক্তা হয়ে উঠেন।

আত্মবিশ্বাসী বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ছাত্রাবস্থায় দীর্ঘদিন কালাজ্বরে আক্রান্ত ছিলেন।কিন্তু তাঁর স্বপ্ন লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেই। টাকা নেই। কষ্ট করে জোগাড় হলো টাকা। লণ্ডন যাত্রার সময় হাজির কিন্তু জ্বর কমে না। ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও জাহাজে করে বিলেতের উদ্দেশ্য  যাত্রা করেন। ভেবে ছিলেন, সমুদ্রের বাতাসে জ্বর চলে যাবে। কিন্তু জ্বর আরো বৃদ্ধির কারণে জাহাজের ডেকের উপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সবাই ভাবলো ছেলেটি লণ্ডন পৌঁছতে পারবে না। লণ্ডন গিয়ে পুরো একবছর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাসে সকল বাধা অতিক্রম করে কেমব্রিজ হতে চার বছর পড়া শোনা করে দেশে ফিরে আসেন। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস না থাকলে আমরা জগৎ বিখ্যাত একজন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র পেতাম না। প্রতীভার আগুন ধার করা নয়, ভেতর হতে জাগ্রত হয়।

স্কুল শিক্ষক বারাক ওবামাকে প্রশ্ন করেছিলেন, বড় হলে কী হতে চাও? তিনি বললেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। সহপাঠীরা হেসে উঠে। তাদের হাসির কারণ একটি নয়, তিনটি। ওবামা বিদেশী, বিধর্মী, কৃষ্ণাঙ্গ। তাঁর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়া অসম্ভব বিষয়। তিনি আত্মবিশ্বাস নিয়ে কঠিন তিন বড় বাধা অতিক্রম করার দৃঢ় সংকল্প করে সাধনা করতে থাকেন। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গরা ভোটার হতো না। ওবামা সেখানে গিয়ে নিজের খেয়ে পড়ে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটার করেন। সে ব্লেকাররা তাঁকে সিনেটর নির্বাচিত করে। একদিন তাদের ভোটে তিনি হয়ে যান আমেরিকার রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির ভবনের নাম  ‘হোয়াইট  হাউস’ সাদা ঘর। এই সাদা ঘরে প্রথম একজন কালো মানুষের প্রবেশ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। আত্মবিশ্বাস থাকলে আমেরিকার প্রেসিডেন্টও হওয়া যায় তা তিনি দুনিয়াবাসীর সামনে প্রমাণ করে ছাড়লেন।

পাণিনি খৃষ্টপূর্ব পাঁচ শত বছর পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেন প্রাচীন ভারতে। সাধারণ ঘরের এক ছেলে।  ছোট বেলায় জ্যােতিষীকে  হাত দেখান। হাত দেখে জ্যােতিষী বলেছিলেন, তাঁর হাতে বিদ্যা রেখাই নেই। বিদ্যার জগৎ তাঁর অন্ধকার। পাণিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, বিদ্যা অর্জন করবেই। ঘরে গিয়ে ছুরি  দিয়ে হাত কেটে বিদ্যা রেখা বের করে জ্যােতিষীর নিকট গিয়ে বলেন, দেখেন আমার বিদ্যা রেখা আমি নিজেই তৈরী করে নিয়েছি। এ ভাবে আমার ভাগ্য আমি নিজেই তৈরী গড়ে নেবো। জ্যােতিষী হতবাক। আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিদ্যা অর্জনে এগিয়ে গেলেন তিনি। হয়ে গেলেন সংস্কৃত ভাষার বিশাল এক পণ্ডিত। প্রাচীন কালে বসে রচনা করেন সংস্কৃত ভাষার ‘অষ্টাধ্যায়ী’ ব্যাকরণ।

আজ যে অমিতাভ বচ্চন দেখছেন, তিনি শেরউড স্কুলে পড়ার সময় ছিলেন উচ্চ-মধ্যবিত্তের এক আরামপ্রিয় সন্তান। এক সময় ‘কুলি’ ছবির শুটিংয়ের সময় দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দুয়ার হতে ফিরে আসেন। একসময় দেনার দায়ে তিনি সব সম্পত্তি হারান। আবার তিনি আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঘুরে দাঁড়ান। আজ তিনি দুনিয়ার কিংবদন্তী।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগে বাস করছি। এই বিজ্ঞান প্রযুক্তির ক্ষমতা কোথা হতে এলো। এটা নতুন কোনো শক্তি নয়, আগেও মানুষের মধ্যে এই শক্তি ছিলো। মানুষ ক্ষমতার অফুরন্ত  ধন ভাণ্ডার। এই ক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে আত্মশক্তি  আবিস্কার করতে হবে। তাতে হবে আত্মজাগ্রণ।

একটা লোককে বিশ্বাস করা যায় সে হলো ‘আমি’। আমি কে তা আত্মস্থ করতে হবে। আমরা অনেক কিছু দেখি, নিজকে দেখিনা। আগে নিজকে দেখার আয়না আবিস্কার করতে হবে। তার নাম ‘আত্মজ্ঞান’ এবং ‘আত্মদর্শন’। আত্মদর্শন আত্মস্থ করতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক সক্রেটিস উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর জীবনের সেরা কথা,’know thyself’ নিজেকে জান। হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ উপনিষদে আছে, ‘আত্মানং বৃদ্ধি’ নিজকে জান। গৌতম বুদ্ধের অমর বাণী, ‘আত্মপ্রদীপভব’ মনের আলোর জগৎ দেখা। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘মার আরেফা নাফসাহু ফাক্বাদ আরাফা রাব্বাহু’ যে নিজের শক্তি সন্ধান পেল সে মহাশক্তির সন্ধান পেল। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,’অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে/ নির্মল করো উজ্জ্বল করো সুন্দর করো হে’।

আল্লামা ইকবাল ‘খুদীকে উচ্চতায় নিয়ে গেলে সবই তোমার হবে’।

কবি হেলাল হাফিজ বলেছেন, ‘নিউট্রন বোমা বুঝ, মানুষ বুঝ না’। মানুষের আত্মশক্তি নিউট্রন বোমার চেয়ে অধিক।

ঈমান মানে বিশ্বাস। মুসলমান হতে সর্ব প্রথম ঈমান আনতে হয় মহাশক্তির উপর। কারণ শক্তির উপর আছে মহাশক্তি। পাওয়ারের উপর সুপার পাওয়ার। বিজ্ঞানীরা নিজের শক্তির উপর বিশ্বাস করে সব কিছু আবিস্কার করেন। যে নিজের শক্তির উপর বিশ্বাসী সে মহাশক্তি উপর বিশ্বাস করা যৌক্তিক। বিজ্ঞানীরা যতকিছু আবিস্কার করেছেন, আগে বিশ্বাস করেছেন। তারপর আবিস্কার করেছেন। এককালে দুনিয়ার সকল মানুষ বিশ্বাস করতো পানির চেয়ে ভারী বস্তু ভাসতে পারবে না। একজন বিশ্বাস করলো সম্ভব। সে জাহাজ আবিস্কার করলো। এক সময় সব মানুষ বিশ্বাস করতো বাতাসের চেয়ে ভারী বস্তু উড়তে পারবে না।

একজন বললো, সম্ভব। সে উড়োজাহাজ আবিষ্কার করলো। সবাই বিশ্বাস করতো তারের মাধ্যমে কথা বলা সম্ভব না। একজন বিশ্বাসী এসে টেলিফোন আবিস্কার করলো। তারপর বলা হলো, তার ছাড়া সম্ভব না। আরেকজন বিশ্বাসী এসে বেতার আবিস্কার করে দেখালো। সবাই বিশ্বাস করতো বেতারে ছবি দেখা সম্ভব নয়। আরেক বিজ্ঞানী টেলিভিশন আবিষ্কার করে প্রমাণ করলেন, বেতারে ছবি দেখা সম্ভব। মানুষ একসময় বিশ্বাস করতো জ্বীন পরী ফেরেস্তারাই আকশে উড়বে, মানুষ নয়। বিশ্বাসী মানুষেরাই মহাকাশ বিজয় করলো। মানুষের অফুরন্ত শক্তি।

সে শক্তি শুধু বিশ্বাসীরাই উপলব্ধি করতে পারেন। তাই মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক গুরুত্বপূর্ণ বিধান বর্ণনার আগে বার বার একটি বাক্য জুড়ে দিয়েছেন। তা হলো,’ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আমানু’ ‘হে বিশ্বাসীগণ। এই বাক্যটি দ্বারা বুঝাতে চেয়েছেন, বিশ্বাসীদের জন্যই আমার এই কিতাবের বিধান, অবিশ্বাসীদের জন্য নয়।  ‘আমানু’ (বিশ্বাসী) শব্দটি কোরআনে ২৪৯ বার গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন।

পবিত্র কোরআনে বর্ণনা আছে,’আল্লাহ তাদের সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছেন যারা বিশ্বাসী এবং জ্ঞানী’।

মহাকালের মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কোরআন নাজিল এবং নবুয়ত প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই সর্ব ধর্মের মানুষের নিকট ‘আল আমিন’ (বিশ্বাসী)  হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। বিশ্বাসীর নিকটই মানুষ সত্য ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করেন।

আপনি কী ভাবছেন, আপনি ব্যর্থ? না কখনো আপনি ব্যর্থ হবেন না,যদি বিশ্বাসী হন। এটি কোন মানুষের ঘোষণা নয়,মহান আল্লাহ পাকের ঘোষণা,’ক্বাদ আফলাহাল মোমেনুনা’ বিশ্বাসীরাই সফল হন।(কোরআনঃ২৩ঃ১)

বিশ্বাসীদের বিশ্ব, বিশ্বাসীরাই বিজয়ী হবেন।ইনশাল্লাহ।(বর্তমান হতাশ তরুণদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে লেখাটি পোস্ট ও শেয়ার করলে উপকৃত হবে)।

নিউজটি শেয়ার করুন :