১৯৭০ সাল বছর জুড়েই পশ্চিম পাকিস্তান ও ইস্ট পাকিস্তান এর ভিতর ক্ষমতা দেয়া নেয়া নিয়ে ইদুর বিড়াল খেলা চলতেই থাকলো।১৯৭১ সালের প্রথম থেকেই আচ করা যাচ্ছিলো দেশে কিছু একটা ঘটনা ঘটবে।বাবা তেমনই কিছু আচ করতে পেরে সিদ্ধান্ত নিলেন মা সহ তিন ভাইবোনকে নানার বাড়ীতে নিরাপত্তার জন্য পাঠিয়ে দিবেন। এই সংবাদে তো ভিষণ খুশি নানার বাড়ীতে যাব,মামাতো ভাইবোনদের সাথে খেলাধুলা করবো। বেশ মজা হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক বাবা ছুটি নিয়ে আমাদেরকে নানার বাড়ীতে রেখে তিনি আবার ঢাকায় একাকী ফিরে গেলেন।নানার বাড়ীতে বেশ মজার দিন কাটতে লাগলো। মা আমাদের পড়ার জন্য বাসায় প্রাইভেট পড়ার জন্য রজিবুল মাস্টারকে রেখে দিলেন। আমরা বাসায় শুধু প্রাইভেট পড়ি।
মোস্তফা হারুন, সিনিয়ার সহ-কারী পুলিশ সুপার, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।
১৯৭১ সালের কিছু স্মরনীয় কথা যা আজকেও ভুলতে পারিনি, তখন আমার বয়স ৭ বছর। যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বাবার সাথে আর দেখা হলোনা। বাবা মুক্তি যুদ্ধ্যে চলে গেছেন। তিনি ভারতে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে বিভিন্ন অপারেশনে নিজেই অগ্রনী ভুমিকা পালন করতে লাগলেন। বাবার সাথে বগুড়ায় যারা কাজ করতেন তারা হলেন মুক্তিযোদ্ধা তপন,রানা,খসরু, ফারুক সহ অনেকেই।আমরা তখন মায়ের সাথে নানীর গ্রামের বাড়ি শাজাহানপুর উপজেলার চুপিনগর গ্রামে।আমাদের গ্রাম যখন হানাদের দ্বারা আক্রমন হতো তখন আমরা মামাদের নির্মিত মাটির ব্যাংকারে আশ্রয় নিতাম।মাঝে মধ্যে গ্রামের বড়দের নিরদেশে, মুক্তি যোদ্ধাদের খাবার ও পানি পোটলা বেধে খালি গায়ে হাফ প্যান্ট পড়ে মাথায় করে ঝুকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা দের নিকট নিয়ে যেতাম।আমরা তখন বুঝতে পারিনি এই কাজটি জীবনের জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ।
আমারা শিশুর দল বেশ আনন্দ পাচ্ছিলাম।অনেক দিন বাবাকে দেখিনা,একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করলাম,মা বাবা আসে না কেন?উত্তরে মা বলতেন দেশ স্বাধীন হলে তোর বাবা আসবেন।তখন বুঝতাম না দেশ স্বাধীন কি।রাতে মা আমাদের ভাই বোনদের বাবার কথা,যুদ্ধের কথা,হানাদের গল্প শুনিয়ে ঘুমিয়ে দিতেন।একদিন রাতে ভাইবোন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম ব্যাংকারে।খুব ভরে ঘুম ভেংগে গেল।দেখলাম আমাদের কাছে স্টেনগান হাতে উস্ক খুস্ক চুলে লম্বা দাড়িওয়ালা এক লোক মার সংগে কথা বলছে।
লোক টিকে দেখে আমরা ভয়ে আবার লুকিয়ে পড়লাম।তখন মা আমাদের ডাকলেন এবং বললেন ভয়ের কিছু নেই এটা তোমাদের বাবা,রাতে তোমাদের দেখতে এসেছে।বাবা মায়া ভরা চোখে আমাদের কাছে ডাকলেন, আমরা তখনও বিস্বাস করছিলাম না।আমাদের বাবা দেখতে এমন কাল হয়েছে কেন?বাবার তো বড় চুল ও বড় দরবেশদের মত দাড়ি ছিল না।অবাক নয়নে বাবার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছি।বাবা আমাদের মনের অবস্তা বুঝতে পেরে কাছে এসে আমাদের। বুকে জড়িয়ে ধরে চুমো দিয়ে আদর করে আমাদের ভয় ভাংগালেন।বললেন আমার সময় নেই আমি এখনি চলে যাব।তোমাদের একনজর দেখে গেলাম,আবার কবে দেখা হবে জানিনা।
সকাল সকাল পান্তা ভাত খেয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।যুদ্ধ যখন শেষ হল বাবা ফিরে এলেন।বাবা আবার সরকারী চাকুরীতে যোগদান করে ১৯৭৫ সালে আমাদের নিয়ে পোস্টিং প্লেস রাজশাহীতে নিয়ে চলে গেলেন।পরবরতীতে জীবনে অনেকবার আব্বার যুদ্ধের কাহীনি তার মুখ থেকে শুনতাম।দেশকে ভালবাসতে শিখলাম।যুদ্ধের সময় মানুস মানুসকে কত ভালবাসতে দেখছি,এখন সেই ভালবাসা মানুসের মধ্যে খুজে পাই না।ছোট বেলার সেই মধুর স্বরনীয় মুহুর্ত আজও ভুলতে পারিনা। দেশের জন্য আবার কি আমরা এক কাতারে দাড়াতে পারিনা?সেসময় শুনেছিলাম ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অনেক সাহায্য সহযোগিতা করেছে।এখন ভাবি এই সাহায্যের পিছনে ভারতের কোন স্বার্থ লুকিয়ে ছিলো কিনা! (চলবে)
হতে লাগলো। (চলবে)
লেখক: মো: মোস্তফা হারুন বন্দ্রেরী, সিনিয়ার সহ- কারী পুলিশ সুপার, ২ এপিবিএন, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।