আ.সা.আবু তালেবঃ রোগী সেবা করাই ডাক্তারের পরম ধর্ম। সৎ নিষ্ঠাবান ডাক্তারের সেবায় অসুস্থ রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে অধিকাংশ ডাক্তার টাকার লোভ সংবরন করতে না পেরে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। চিকিৎসা সেবামূলক কাজ হলেও অধিকাংশ ডাক্তার রোগী সেবার নামে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিজের পেট সেবায়ই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালের অধিকাংশ ডাক্তার চিকিৎসার নামে জনবসতি পূর্ণ এলাকায় ক্লিনিক খুলে ব্যাবসা পেতে বসেছে। ডিজিটাল উন্নত চিকিৎসার কথা বলে রোগীদের হাসপাতাল থেকে নাম কেঁটে কৌশলে ক্লিনিকে ভর্তি করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে রোগী সুস্থ হলেও সর্ব শান্ত হয়ে বাড়ি ফিরছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, কোন কোন সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার খাতায় হাজির দিয়েই অথবা ছুটি নিয়ে ক্লিনিকে চিকিৎসার নামে নিজ ব্যাবসায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অসংখ্য গরীব রোগীদের চিকিৎসা নিতে চরম দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
লৌহজং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরেজমিনে গিয়ে ডাক্তারের উপস্থিতি কম কেন জানতে চাইলে অন্যান্য ডাক্তার জানান, মোট চার জন ডাক্তার অনুপস্থিত রয়েছেন। ডাক্তার হমায়ূন কবির ও অন্য আরেক জন ডাক্তার ছুটিতে আছেন। ডাক্তার হুমায়ূন রাজীব ট্রেনিং এ আছেন ও ডাক্তার মনিরুজ্জামান বদলী হয়ে গেছেন। এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ থেকে ১০০০ রোগী চিকিৎসা সেবা নিতে আসে। ডাক্তারের অনুপস্থিতি কম থাকায় চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। রোগীদের দূর্ভোগও বাড়ছে। কতিপয় কসাই ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসায় রোগীদের বিভিন্ন রোগের জন্য সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এন্টি বায়েটিক দিচ্ছে। এতে রোগীরা মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে মুক্তারুজ্জান খান নামক জনৈক ফার্মাসিষ্ট জানান। তিনি আরো জানান, এন্টিবায়েটি ওষুধ খাওয়ার পর রোগী দ্রুত সুস্থ হলে ডাক্তারের প্রতি আস্থা ও ভালবাসা সৃষ্টি হয়। এ ভাবে ওষুধের পাশাপাশি এন্টি বায়েটিক খাওয়ায় রোগীর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এক পর্যায়ে কোন ওষুধে কাজ না হওয়াতে রোগীকে মৃত্যু অবধি জমি বিক্রি করে দামি দামি ইনজেকশন নিতে হচ্ছে।
অনুসন্ধান চালিয়ে জানা যায়, লৌহজং উপজেলাধীন শিমুলিয়া ঘাটের চা বিক্রেতা মোঃ বজলুর রহমানের স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা (৫০ ) দীর্ঘদিন যাবৎ বাত ব্যাথায় ভুগছিলেন। অত্র উপজেলার মালির অংক বাজারের স্বপন ডাক্তারের চিকিৎসায় রোগী তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয় শুনে তার নিকট শরনাপন্ন হন। চিকিৎসার শুরুতেই সুস্থ হয়ে ওঠলে ডাক্তারের প্রতি তাদের অগাধ বিশ্বাস ও ভালবাসা সৃষ্টি হয়। হঠাৎ এন্টিবায়েটিকের প্রভাবে শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারেই হারিয়ে ফেলেন তিনি। বজলুর ন অভিযোগ করে বলেন , স্বপন ডাক্তার চিকিৎসা সেবার নামে এ পযর্ন্ত তার নিকট থেকে প্রায় ৫০,০০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এরপরও তার স্ত্রী সুস্থ হয়নি।
এছাড়া অত্র ঊপজেলায় ব্যঙের ছাতার মত অসংখ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে ওঠেছে।গুণগত মান নিয়ে রয়েছে মানুষের নানা অভিযোগ। লৌহজং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ল্যাব টেকনেশিয়ান অসীম কুমার সাহা (৫২) ছুটির পরে মালিরঅংক বাজারে পদ্মা ক্লিনিকে, ঘোড়দৌড় বাজারস্থ সন্ধানী ক্লিনিকে, ডাক্তার আব্দুল মান্নান ডায়াগনিষ্টিক সেন্টারে ও অন্য আরেকটি ক্লিনিকে রক্ত সহ বিভিন্ন পরীক্ষা করে রিপোর্ট প্রদান করছেন । রোগীর রিপোর্ট সন্দেহ হলে অন্য ক্লিনিকে বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রক্ত পরীক্ষায় অন্য রকম রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে। এতে রোগীর জীবন বিপন্ন হয়ে ওঠেছে। দূঃখজনক হলেও সত্যি উন্নত মানের যন্ত্রপাতি না থাকায় ওল্টাপাল্টা রিপোর্ট অসীম কুমারের নিকট থেকেই হচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অন্য লোকের মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করে রেখে দেয়।ছুটির পরে একে একে চারটি ক্লিনিক ও ডায়াগনিস্টক সেন্টারে নমুনা পরীক্ষা করে রিপোর্ট প্রদান করছেন। বহু ক্ষণ পর পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেওয়ায় সংগৃহীত নমুনার মান নষ্ট হয়ে যায় বলে উক্ত ফার্মাসিষ্ট জানিয়েছেন।
সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়, সারা বাংলাদেশে ডায়াগনস্টিক টেস্টে নয়ছয় চলছেই। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় সরকার নির্ধারিত মূল্য তালিকা না থাকায় ইচ্ছা মতো ফি নিচ্ছে হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো। দামের পার্থক্যের পাশাপাশি মান নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট অভিযোগ। নিজস্ব ল্যাবরেটরি না থাকলেও নমুনা সংগ্রহ করে অন্য প্যাথলজিতে টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট সংগ্রহ করা হচ্ছে। ভুল আর অসঙ্গতিতে ভরা রিপোর্টে দেশের স্বাস্থ্য সেবার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। বাংলাদেশ একাডেমিক অব প্যাথলজিস্ট বলছে, রোগ নির্ণয়ে কোন পরীক্ষার জন্য রোগীদের কত টাকা দিতে হবে এটা কখনো নির্ধারণ করা হয়নি। এ বিষয়ে কোন সরকারি নির্দেশনা ও নেই। ফলে রোগীদের কাছ থেকে খরচের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাংকা নিচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক অভিযোগ রয়েছে , ডাক্তারদের রেফারেন্সে রোগীরা আসছে এসব নামসর্বস্ব ক্লিনিকে। অনেক সময় দালালদের মাধ্যমেও সরকারি হাসপাতাল থেকে টেষ্টের জন্য রোগী নিয়ে আসা হচ্ছে এসব ক্লিনিকে। রেফারেন্সের ফলে এসব ক্লিনিক থেকে কমিশন ঢুকছে রেফারেন্স প্রদানকারী ডাক্তারের পকেটে।
এই কমিশনের বাড়তি টাকা আদায় করা হচ্ছে রোগীদের নিকট থেকে। নামসর্বস্থ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভূয়া রিপোর্ট তৈরী করায় দেশের চিকিৎসা সেবায় সাধারণ মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তাই সেবা পেতে ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর পাড়ি দিচ্ছে মানুষ। নিজস্ব ল্যাবরেটরি না থাকলেও নমুনা সংগ্রহ করে অন্য প্যাথলজিতে টেষ্ট করিয়ে রিপোর্ট সরবরাহ করা হচ্ছে রোগীদের।অনেক সময় নমুনা অন্যত্র নিয়ে যাওয়ায় হারাচ্ছে গুণগত মান। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) প্রাক্তন সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপ উপচার্য অধ্যাপক রশিদ – ই – মাহবুব জানান, স্বাস্থ্য পরীক্ষায় মূল্য তালিকা প্রদর্শনের পাশাপাশি মূল্য নির্ধারণও জরুরী। কোন যন্ত্র ব্যাবহার করলে মূল্য কত আসবে সেটাও তদারকি করতে হবে। নয়তো রোগীদের ঠকানোর নতুন পন্থা বের করবে নামসর্বস্ব ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, বেসরকারী হাসপাতাল – ক্লিনিকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফি নিয়ে রীতিমতো নৈরাজ্য চলছে। স্বাস্থ্য সেবা পরিণত হয়েছে লাভজনক ব্যাবসায়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সিবিবি টেষ্টের জন্য নেওয়া হয় ১৫০ টাকা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএম ইউ) নেওয়া হয় ২০০ টাকা, বারডেমে নেওয়া হয় ৩০০ টাকা, ইঊনাইটেড হাসপাতালে ৫৫০ টাকা, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের মতিঝিল শাখায় ৪০০ টাকা, ল্যাব এইড মিরপুর শাখায় ৫৫০ টাকা, সেট্রাল হাসপাতালে ৪৫০ টাকা, গ্রিন ভিউ ক্লিনিকে ৪০০ টাকা , গ্রিন লাইফ হাসপাতালে ৫০০ টাকা, এবং আইসিডিডিআরবিতে ৮৪০ টাকা নেওয়া হয়। মূত্র পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় ২০ টাকা, বিএসএমএসইউতে নেওয়া হয় ১০০ টাকা, বারডেমে নেওয়া হয় ১৫০ টাকা, ল্যাব এইডে নেওয়া হয় ৩০০ টাকা, ইউনাইটেডে নেওয়া হয় ৫২০ টাকা, আইসিডিডিআরবিতে নেওয়া হয় ৩৭০ টাকা, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আল্ট্রাসনোগ্রাফি অব অ্যাবডোমেনে খরচ হয় ১১০ টাকা, বিএসএমএমইউতে ২৫০ টাকা, বারডেমে ১০০০ টাকা, ল্যাব এইডে ২০০০ টাকা, আইসিডিডিআরবিতে নেওয়া হয় ২২০০ টাকা, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল মতিঝিল শাখায় ১০৩০ টাকা, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ১২০০ টাকা, গ্রিন ভিউ ক্লিনিকে ১৫০০ টাকা, গ্রিন লাইফ হাসপাতালে ১৬০০ টাকা নেওয়া হয়। অধিকাংশ টেস্টে দামে এমন আকাশ – পাতাল পার্থক্য জীবিত রোগীদের জবাই করে হত্যার সমতূল্য।
সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যয় হিসেবের তথ্যে দেখা যায়, সার্কভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে রোগীর নিজস্ব ব্যয় সবচেয়ে বেশী বাংলাদেশে। মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ রোগী নিজের পকেট থেকে খরচ করে। বাংলাদেশের নিকটবর্তী খরচ হয় আফগানিস্তানে, সেখানে ৬৪ শতাংশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জানান, প্যাথলজি সেবার মূল্যমান নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরী। স্বাস্থ্য খাতে শৃংখলা ফেরাতে আইন তৈরীর খসড়া অনেক দিন ধরে চলমান। এ খাতে অরাজকতা আছে, যুদ্ধ আছে কিন্তু অবমুক্তি নেই। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দৃষ্টি দিবেন কি?