শিরোনাম

১৫ আগস্টে ইসলামী মূল্যবোধ ভূলুণ্ঠিত হয়েছিলো মালিবাগ শহীদি মসজিদের আঙ্গিনায় -কে এম আতিকুর রহমান

২০০২ সালে ইসলামী মূল্যবোধ তখন রাজনৈতিক অঙ্গণে বিশেষ পরিচিত শব্দ। শব্দটির উৎপত্তি কুরআন হাদীস থেকে না হলেও ইসলাম শব্দটি থাকার কারণে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে ছিল এটি মুক্তির মূলমন্ত্র। আর এ শব্দের প্রয়োগে জাতীয় নির্বাচন উৎরে যাওয়ায় “ইসলামী মুল্যবোধের সরকার” হিসেবে জনশ্রুতি ব্যাপক পরিচিত করে তুলেছিল তৎকালিন চারদলীয় জোট সরকারকে। তখনকার সদ্যবিদায়ী আওয়ামী শাসনামলের বিভিন্ন বিতর্কিত ও ইসলামবিরোধী কর্মকা- বিশেষ করে ক্ষমতার শেষভাগে ফতওয়া নিষিদ্ধ করে দেয়া হাইকোর্টের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় দেশব্যাপী ফুঁসে উঠা ধর্মপ্রাণ মুসমানদের ওপর সরকারের হামলা-মামলা ও বি-বাড়িয়ায় ছয়জনকে শহীদ করায় এমনিতেই জনগণ ক্ষিপ্ত ছিল। সে সময়ে ইসলাম রক্ষার মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে কয়েকটি ইসলামী দল নিঃশর্তভাবে বিএনপির নেতৃত্বে জোটে যোগ দেয় এবং ‘ইসলামী মূল্যবোধ’ সে জোটের মৌলিক শ্লোগান হিসেবে প্রচার করে। ওলামায়ে কেরামের একটি অংশ সেই জোটে যোগ দিলেও চরমোনাই পীর সাহেবসহ অপরাপর ওলামায়ে কেরাম নিতান্তই ইসলামী স্বার্থরক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা নেই দেখে জোটে যোগ দেননি।

সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল ওলামায়ে
কেরামের সংশ্লিষ্টতায় যেহেতু ইসলামী মূল্যবোধের বিএনপি সরকার ক্ষমতায়, তাই দেশে অতীতের চেয়ে মুসলমানদের ঈমান-আকীদা বেশি হেফাজতে থাকবে। কিন্তু মানুষের সে ভুল ভাঙতে বেশি দিন সময় লাগেনি। ১৫ আগস্ট ২০০২ সালে রাজধানীতেই বিএনপি দলীয় নেতার গুণ্ডাবাহিনীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল মসজিদ রক্ষা করতে যাওয়া বীর মুজাহিদদের। আর এ ঘটনা ধামাচাপা দিতে গিয়ে শীর্ষ ওলামাদের হাতেই ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল তথাকথিত শ্লোগান “ইসলামী মূল্যবোধ” এর।

যেভাবে ঘটনা : কয়েক বছর আগে রাজধানীর মালিবাগ এলাকায় প্রধান সড়কের পাশে টিএন্ডটি কলোনীতে এলাকার মানুষ নামাজ আদায়ের জন্য একটি মসজিদ তৈরি করে। ধীরে ধীরে মুসল্লী সংখ্যা বাড়তে থাকে, মসজিদের নামকরণ হয় বাইতুল আজিম জামে মসজিদ। কিন্তু পার্শ্ববর্তী জমির দখলদার যুবদল নেতা ইঞ্জিনিয়ার তৌফিক ও তার সহযোগীদের সেই জায়গায় মার্কেট বানানোর প্ল্যানে ছেদ পড়ে। মসজিদ যাতে মুসল্লীহীন হয়ে পড়ে সেজন্য প্রচেষ্টা চালায় বিভিন্নভাবে। মসজিদকে অবৈধ বানাতে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে বেশ কয়েকবার সালিশ দরবারও করে। কিন্তু ইমাম, খতিব ও মুসল্লীদের সচেতনতার কারণে পেরে উঠছিল না কিছুতেই। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় ক্ষমতা ও অস্ত্রের জোর ব্যবহার করার। ১৫ আগস্ট ফজরের নামাজ পড়তে গেলে মুসল্লীরা দেখতে পায় মসজিদের প্রবেশপথ দেয়াল তুলে আটকানো। ইশার নামাজে যেপথ দিয়ে তারা বের হয়েছে, ভোরবেলা সেপথ বন্ধ হয় কিভাবে? তাদের আর বুঝতে বাকী থাকে না এ কাজ তৌফিক গংদের। মুসল্লীদের আনাগোনা নিয়ন্ত্রণে এনে মসজিদটি পরিত্যাক্ত ঘোষণা করে দখল করার ফন্দি এটেছে সে। দ্রুত সকল মুসল্লী এবং স্থানীয় মাদরাসা চৌধুরীপাড়া ও জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগের শিক্ষক ও ছাত্রদের কানে এ খবর গেলে উত্তেজনায় ফেটে পড়ে সকলে। ডাক দেয়া হয় বিক্ষোভ সমাবেশের।

আর কিছু নয়, মসজিদ দখল করা হয়েছে, তাও আবার মসজিদের শহর ঢাকাতে? বিক্ষোভে উত্তাল মানুষের মধ্য থেকে দাবী উঠতে থাকে এখনই মসজিদকে দখলমুক্ত করা হোক। ওদিকে তৌফিক গং মসজিদের দখল বজায় রাখতে চারিদিকে স্বশস্ত্র আনসারদের পাহারা বসিয়েছিল। সমাবেশের এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ জনতার একটি দল ছুটলো মসজিদের প্রবেশপথে তৈরি করা নতুন দেয়াল ভাঙতে। আনসাররা বাধা দিলেও জনতার রুদ্রমূর্তি দেখে প্রথমে পিছু হটে তারা। দেয়াল প্রায় ভেঙে ফেলেছে এ পর্যায়ে আনসাররা আবার এগিয়ে আসে, তৌফিক গংদের নির্দেশে অতর্কিত গুলি চালায় তারা। নিরস্ত্র মুসল্লী ও মাদরাসার ছাত্ররা হতভম্ব হয়ে যায় ঘটনার আকস্মিকতায়। রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায় মালিবাগের রাজপথ। গুলিবিদ্ধ আহতদের হাসপাতালে নেয়া হয়, খবর আসে গুলিবিদ্ধ তিন ছাত্র ও এক মুসল্লী গুরুতর আহত। বিক্ষুব্ধ মানুষ তখন আরও ক্ষিপ্ত হয়ে আশে পাশে দোকানপাটে ভাংচুর চালিয়ে মসজিদে ঢুকে পড়লে আনসাররাসহ দখলদাররা পালিয়ে যায়। এর মধ্যে চার জন নিহতের খবর আসলে তা মসজিদের মাইকে প্রচার করা হয় ও শহীদদের জন্য মাগরীব বাদ সেখানে দোয়ার আয়োজন করা হয়। ইতোমধ্যে নিহতদের পরিচয় সনাক্ত হয়- ১। শহীদ হাফেজ আবুল বাশার (মালিবাগ মাদরাসার ছাত্র), বাড়ি পিরোজপুর জেলার খলিশাখালীতে, ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের কর্মী ও খিলগাঁও থানার দায়িত্বশীলও ছিল। ২। শহীদ রেজাউল করীম ঢালী (চৌধুরীপাড়া মাদরাসার ছাত্র) বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া থানায়, সেও ইশা ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিল ৩। শহীদ হাফেজ ইয়াহইয়া (মালিবাগ মাদরাসার ছাত্র) বাড়ি মোমেনশাহী জেলার ফুলপুর থানায়। ৪। শহীদ জয়নাল আবেদীন (ফেনী জেলার ডুমুরিয়া গ্রামের দিনমজুর) যিনি মেয়ের বিয়ের টাকা যোগাতে ঢাকায় এসেছিলেন।

মসজিদ দখলমুক্ত হলেও আন্দোলনকারী বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতার মনে তখন প্রচন্ড- দ্রোহ। শহীদদের লাশের অপেক্ষা করছিল সবাই, একনজর দেখে জানাজা দাফন দিয়ে কিছুটা কষ্ট ঘুচানোর পরিকল্পনাও করছিল অনেকেই। কিন্তু ওদিকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে আরেক অধ্যায়। ইসলামী মূল্যবোধের সরকারের ভাবমূর্তি কোনক্রমেই নষ্ট হতে দেয়া যাবে না, তাতে যদি আবারও গুলি চালাতে হয় তাও চলবে এমন পরিকল্পনাই চলে রাতভর। উদ্দেশ্য শহীদদের খুনীদের বিচার নয়, ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে খুনিদের রক্ষা করা। সেটাই স্পষ্ট হলো তাদের পরবর্তী কর্মকা-ে। প্রথমে মিটিং থেকে বের হয়ে তারা প্রতিবাদ সমাবেশ ও জানাজার কথা বললেও সকালে জানাজার অপেক্ষমানদের জানানো হলো, ঢাকায় কোন জানাজা হবে না, গ্রামের বাড়িতে হবে। শহীদদের লাশ দেখা ও জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে বিশাল জানাজায় অংশগ্রহণের সৌভাগ্য আর হলো না সতির্থদের।

এখানেই শেষ নয়, কেউ যাতে এ নিয়ে পরে আন্দোলন না করে সে ব্যাপারেও হুশিয়ার করে দেয়া হলো। পরদিন বিভিন্ন মাদরাসায় জোটভুক্ত ইসলামী দলের নেতারা গিয়ে বলে দিল, কোন মিছিলে যাতে কেউ না যায় তা নিশ্চিত করতে। কোন এক অদৃশ্য হালুয়া রুটি শহীদদের মাদরাসার ওস্তাদদেরও মুখ বন্ধ করে দিল নিমিষেই। যে মাদরাসার ছাত্র শহীদ হয়েছে তার

নিউজটি শেয়ার করুন :