আ.সা. আবু তালেব ঃ শ্রমিকরাই গোটা বিশ্বের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। সভ্যতার কারিগর, উন্নয়নের রূপকার। ওরা যদি ধর্মঘট ডেকে বিশ্ব অচল করে দেয় তবে থমকে যাবে উন্নয়নের চাকা। ধবংস হবে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি। দূঃখজনক হলেও সত্যি উন্নয়নের রূপকার খ্যাত শ্রমিকরা যুগ যুগ ধরে অবহেলিত, নির্যাতিত, নিঃস্পেষিত। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ভারতের অবহেলিত ও বঞ্চিত কৃষকগণ প্রায়ই আত্মহত্যা করছে। ২০১৩ সাল থেকে সরকারি হিসেবে প্রতি বছর ১২ হাজারের বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছে। সরকারি হিসেবে যদি এমন হয় তবে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। ইতিহাস সাক্ষী কৃষি কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের নির্যাতন নির্বাচনেও অনেক প্রভাব ফেলে।
ভারতের তামিল নাড়ুর রাজ্যের নাগপাত্তিনাম জেলার কিলভেলমানি গ্রামে বৃটিশ শাসনের অবসান হওয়ার পর অর্থাৎ ভারতে স্বাধীনতার দীর্ঘ ২০ বছর পর সবুজ বিপ্লবের কল্যাণে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটলেও ভূমিহীন কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেনি। ওরা ছিল নিতান্তই অবহেলিত ও নিগৃহীত। মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি তৎকালীন সময়ে এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৬৮ সালের শেষ ভাগে ভূমিহীন কৃষক ও কৃষি শ্রমিকগণ বিপ্লবী চেতনায় ঐতিহাসিক লাল পতাকা বিভিন্ন স্থানে টাঙিয়ে দেয়। জোতদার ভূমি মালিকরাও এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারাও ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন স্থানে হলুদ পতাকা টাঙিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে আন্দোলনের সাথে সমৃক্ত কৃষি শ্রমিক ছাঁটাই হতে থাকে। এতে উভয় পক্ষে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। কৃষি শ্রমিকরা ক্ষেতের পাঁকা ফসল কাঁটা বন্ধ করে দেয়। নিরুপায় হয়ে ক্ষেতের মালিকরা অন্য এলাকা থেকে কৃষি শ্রমিক এনে ফসল কাঁটার চেষ্টা করলে উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করে।
১৯৬৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর আনুমানিক রাত ১০ টায় জমির মালিক সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে পুলিশের ভ্যান ব্যবহার করে কৃষি শ্রমিকদের গ্রামে হামলা চালায়। পালানোর পথ বন্ধ করে গুলি বর্ষন করতে থাকলে ২ জন নিরীহ শ্রমিকের করূণ মৃত্যু ঘটে। অসহায় কৃষি শ্রমিক নারী শিশু ও বৃদ্ধগণ দৌড়ে আট ফুট দৈর্ঘ্য ও নয় ফুট প্রস্থের একটি ছোট কুঁড়েঘরে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নেয়। আক্রমণকারীরা চতুর্দিকে ঘিরে কুড়েঘরটিতে আগুন জ্বালিয়ে মোট ৪৪ জনকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে হত্যা করে। এদের মধ্যে ৫ জন বয়ঃবৃদ্ধ, ১৯ জন মহিলা ও ২৩ জন শিশু ছিল। উল্লেখ যে, এ ঘটনার জন্য দায়ী ১০ জন ভূমি মালিকের নিম্ন আদালতে ১০ বছরের কারাদণ্ড হলেও উচ্চ আদালতে সকল অপরাধী মুক্তি পেয়ে যায়। ১৯২১ সালের ২০ মে বৃটিশ আমলে তৎকালীন ভারতের অবিছেদ্য অংশ বতর্মানে বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলার স্টিমার ঘাটে বৃটিশ মালিক ও তার গুন্ডা বাহিনীর গুলিতে শতাধিক চা শ্রমিকের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল মেঘনা নদীর পানি।
আমেরিকার আরকানস রাজ্যের ফিলিপস অঞ্চলে শ্বেতাঙ্গ মালিক কর্তৃক শতাধিক কৃষনাঙ্গ তুলা চাষিরা গুলিতে ও জবাই হয়ে মৃত্যু বরণ করে। তাদের লাল রক্তে রঞ্জিত হয় সাদা তুলা। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় জার্মান সেনাবাহিনী জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষকে আটকে বন্দী শিবিরে রেখে প্রতিদিন ১০/১২ ঘন্টা অমানবিক শ্রম নির্ভর কাজে লাগিয়ে দিতো। যুদ্ধের জন্য রাস্তা নির্মাণ, খাদ্য উৎপাদন, যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরির কারখানা নির্মাণ, মাটির নিচে টানেল, অস্ত্র – গোলা বারুদের কারখানা নির্মাণ ইত্যাদি ভারি ভারি কাজ করাতো । বিনিময়ে তাদের নূন্যতম খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান ও নিশ্চিত ছিলনা।
যারা কাজ করতে অস্বীকার করতো; তাদের উলঙ্গ করে পেটানো হতো এবং প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হতো। ভ্লাদিমির লেলিন ও যোশেক স্টালিনের শাসনামলে সোভিয়েত ইউনিয়নে বাধ্যতামূলক শ্রম আদায়ের জন্য গুলাগ নামক এক ধরনের ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়। এই ক্যাম্পে বন্দিদের নদী খনন, খনি থেকে সম্পদ আহরণ, দূর্গম এলাকায় রাস্তা – ঘাট নির্মাণ, রেল লাইন ও ঘর – বাড়ি নির্মাণ সহ কঠিন কাজ করতে বাধ্য করা হতো। ১৯৫২ সালের মধ্যে ১৬ লাখ বন্দি বাধ্যতামূলক অতিরিক্ত শ্রম ও খাদ্য বস্ত্রের অভাবে মারা যায়।আরো জানা যায়, এ সময় ২৭ লক্ষ ৪৯ হাজার ১৬৩ জন বন্দি রূপী শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে। ” মাও দ্য আননোন স্টোরী ” বইয়ের রচয়িতা এবং মাও এর জীবনী লেখক জাং চাং এবং ঐতিহাসিক জন হলিডের হিসেবে মাও সেতুং এর আমলে বিভিন্ন বন্দি শিবির থেকে বাধ্যতামূলক ভাবে কাজ করার কারণে ও ন্যায্য সুযোগ – সুবিধা না পাওয়ায় ২ কোটি ৭০ লক্ষ শ্রমিক মৃত্যু বরণ করেন।
ডাচ ইতিহাসবিদ জফ্রাংক ডিকোডারের তথ্রানুসারে মাও সেতুংয়ের সামনে ১০ থেকে ৩০ লক্ষ চীনা বাধ্যতামূলক অমানবিক শ্রমের কারণে আত্মহত্যা করে। কঙ্গোতে ১৯০০ থেকে ১৯২০ সাল পযর্ন্ত ফ্রান্সের শাসনামলে শুধু সমুদ্র তীরবর্তী রাস্তা ও রেল লাইন নির্মাণ করে ১৪ থেকে ২০ হাজার শ্রমিক নিখোঁজ হয়ে যায়। বাধ্যতামূলক শ্রমের কারণেই শ্রমিক মৃত্যু হচ্ছে মুসলিম নিধন দেশ মিয়ানমারেও। যুদ্ধ সরঞ্জাম ও রসদ সরবরাহ করার জন্য নির্মিত হয় বার্মা রেলওয়ে।
এই নির্মাণ কাজে বতর্মান দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়ার প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার শ্রমিক ও মিত্র বাহিনীর প্রায় ৬০ হাজার গৃহবন্দি বাধ্যতামূলক শ্রমে। এদের মধ্যে ছিল মালয়ান, তামিল, চাইনিজ, বার্মিজ, থাই এবং অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমিক ছিল। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, নির্মাণকালে প্রায় ১ লক্ষ তামিল বেসামরিক শ্রমিক ও ১২ হাজার ৬২১ জন যুদ্ধবন্দির নির্মম মৃত্যু ঘটে। এদের মধ্যে ৬ হাজার ৯ শত চার জন ব্রিটিশ, ২ হাজার ৮ শত দুই জন অষ্ট্রেলিয়, ২ হাজার ৭৮২ জন ডাচ এবং ১৩৩ জন আমেরিকার যুদ্ধবন্দি ছিল। অনেকেই সে কারণে বার্মা রেলওয়েকে ডেথ রেলওয়ে বলে সম্বোধন করে থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশেও শ্রমিকদের কোন নিস্তার নেই। বিশেষ করে গার্মেন্টস শ্রমিকরা বকেয়া বেতন সহ ন্যায্য দাবি আদায়ে রাজপথে আন্দোলনে নামলেই ওল্টো পেটুয়া বাহিনী কর্তৃক নির্মমভাবে নির্যাতিত হতে হয়। এর কি কোন প্রতিকার নেই? উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জ্ঞাতার্থে দৈনিক ওলামা কন্ঠের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি যে, শ্রমিক নির্যাতন দেশের জন্য কোন শুভ লক্ষণ নয় : বরং অর্থনীতি ধবংসের অনশি সংকেত।